২৫ হাজার টাকার রিকশা গুলশানে সাড়ে ৩ লাখ

গুলশানে চলাচল করা রিকশা। ছবিটি সম্প্রতি তোলা
প্রথম আলো

ঢাকায় নতুন একটি রিকশা কিনতে লাগে বড়জোর ২৫ হাজার টাকা। পুরোনো রিকশার দাম আরও কম, ১৫ হাজারেই পাওয়া যায়। তবে কেউ যদি রিকশা কিনে গুলশান, বনানী ও বারিধারায় চালাতে চান, তাহলে ব্যয় হবে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা। না, গুলশানের রিকশায় বিশেষ কিছু নেই। এতে যন্ত্র লাগানো নেই যে চালকের কষ্ট কম হবে। এর আসন, কাঠামো অন্য এলাকার রিকশার মতোই। অবশ্য গুলশান, বনানী ও বারিধারার রিকশার বিশেষ নিবন্ধন আছে, যা তার দাম ১০ গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

এই নিবন্ধন ছাড়া রিকশা ওই এলাকায় চলতে পারে না। নিবন্ধিত রিকশার সংখ্যাও সীমিত। পুরোনো হলে রিকশা পাল্টে যায়, থেকে যায় নিবন্ধন নম্বরপ্লেটটি। সেটি যে রিকশার পেছনে যুক্ত হয়, সেই রিকশার দাম তাৎক্ষণিকভাবে ১০ গুণ বেড়ে যায়।

রিকশা মালিক ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) কর্মকর্তারা জানান, ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর ওই এলাকায় রিকশা ও গণপরিবহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। মাস দেড়েক পরই আবার তা চালু হয়। তবে কূটনৈতিক এলাকায় নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে সিটি করপোরেশন ওই এলাকায় রিকশার সংখ্যা নির্ধারিত করে দেয়।

এরপর গুলশান, বারিধারা, বনানী ও নিকেতনের বাসিন্দাদের সংগঠন বা সোসাইটি সিটি করপোরেশনের নিবন্ধন বা লাইসেন্স (ব্লু-বুক) আছে, শুধু এমন রিকশাকে তাদের নিজস্ব নিবন্ধনের আওতায় আনে। রিকশাগুলোকে একটি নম্বরপ্লেট দেওয়া হয়, যা রিকশার সামনে টাঙিয়ে রাখতে হয়। এ ছাড়া রিকশাচালকদের পরিচয়পত্র রয়েছে এবং তাঁদের বিশেষ কটি পরতে হয়।

বাসিন্দাদের সমিতি সূত্রে জানা যায়, গুলশান ও বনানীতে নিবন্ধিত রিকশা রয়েছে ৪০০টি করে। বারিধারা ও নিকেতনে চলতে পারে ১০০টি করে রিকশা। নিবন্ধনের জন্য সোসাইটি কোনো টাকা নেয়নি। তবে বছরে একবার চালকের কটি, নম্বরপ্লেট ও ভাড়ার তালিকা টানানোর জন্য সোসাইটিভেদে এক থেকে দুই হাজার টাকা নেওয়া হয়।

গুলশান-বনানীতে নিবন্ধিত রিকশা মালিকদের সমিতিও আছে। এই সমিতির সভাপতি মনিরুজ্জামান ফরাজী প্রথম আলোকে বলেন, সোসাইটির রিকশা আসল লাইসেন্স দেখে দেওয়া হয়েছে। নিবন্ধিত রিকশার সংখ্যা সীমিত। চাহিদাও বেশি। এসব কারণেই দাম বেশি। তিনি আরও বলেন, দাম তিন-সাড়ে তিন লাখ হবে না, বড়জোর দুই-আড়াই লাখ টাকায় একটি রিকশা বিক্রি হয়।

সমস্যা হলো রিকশার দাম এত বেশি হওয়ার মাশুল দিতে হয় সাধারণ রিকশাচালকদের। তাঁরা জানিয়েছেন, ঢাকার অন্য এলাকায় পুরো দিন চালানোর ক্ষেত্রে মালিকেরা চালকদের কাছ থেকে ভাড়া বা জমা হিসেবে নেন ১০০ টাকা। গুলশান-বনানীতে তা এক বেলা বা আট ঘণ্টার জন্য ২৫০ টাকা। দুই বেলায় মালিকের আয় ৫০০ টাকা। অনেক মালিক সারা রাত চালানোর জন্য রিকশা ভাড়া দেন। ফলে পুরো দিনে একটি রিকশা থেকে তাঁর আয় দাঁড়ায় ৬০০ টাকার বেশি। যদিও বাসিন্দাদের সমিতি পুরো দিনের জন্য রিকশার জমা নির্ধারণ করে দিয়েছে ৩০০ টাকা।

দিনে অন্তত ৫০০ টাকা হিসাবে একজন মালিক বছর শেষে একটি রিকশা থেকে আয় করেন ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ফলে দুই বছরে তাঁর বিনিয়োগ উঠে যায়। কিন্তু রিকশাটির নম্বরপ্লেটের দাম আগের মতোই থেকে যায়।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে নিবন্ধিত রিকশা আছে ১ লাখ ৮০ হাজারের মতো। তবে রিকশা চলে বহুগুণ। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গত বছর থেকে নতুন করে রিকশার লাইসেন্স দেওয়া শুরু করেছে। যদিও ঢাকার অন্য এলাকার রিকশার গুলশান-বনানীতে ঢোকার সুযোগ নেই। প্রতিটি মোড়ে সোসাইটির নিরাপত্তাকর্মীরা বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

গুলশানের রিকশায় আয় বেশি দেখে এতে বিনিয়োগ করেছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরাও। তাঁদের একজন আওয়ামী লীগের একটি সহযোগী সংগঠনের গুলশান থানা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সম্প্রতি ৭ লাখ ২৫ হাজার টাকায় দুটি রিকশা কেনেন। একেকটির দাম পড়ে ৩ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই নেতা প্রথম আলোকে বলেন, সাড়ে তিন লাখ টাকা দিয়ে কিনলেও বিনিয়োগ লাভজনক।

ঢাকায় নিবন্ধনজনিত একই কারণে পাঁচ লাখ টাকার একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ১৪ লাখে বিক্রি হয়। মালিকেরা চালকদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা জমা হিসেবে নেন। চালকেরা সরকার নির্ধারিত ভাড়া না মেনে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নিজেদের খেয়ালখুশিমতো টাকা আদায় করেন।

অবশ্য রিকশা ভাড়া গুলশান-বনানীতে খুব একটা বেশি, তা বলা যাবে না। ভাড়া নির্ধারণ করা আছে। তার বেশি নেওয়ার সুযোগ নেই। যেমন গুলশান ১ নম্বর সেকশন থেকে বনানী চেয়ারম্যানবাড়ী পর্যন্ত ভাড়া ৪০ টাকা। চালকেরা বলছেন, রাজধানীর অনেক এলাকায় ভাড়া এর চেয়ে বেশি।

তাহলে কেন চালকেরা গুলশান-বনানীতে রিকশা চালান—এর উত্তর পাওয়া যায় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে। তাঁরা বলছেন, জমা বেশি হলেও আয় খারাপ না। রাস্তা ও পরিবেশ ভালো। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যাত্রীরা ভাড়ার চেয়ে কিছু বেশি টাকা দেন।

অবশ্য নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চালক বলেন, মাত্র আট ঘণ্টায় ২৫০ টাকা জমা। তার ওপর নিজের খরচ। বাড়তি আয় করতে গিয়ে বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ থাকে না। জমা যদি অন্য এলাকার মতো ১০০ টাকা হতো, তাহলে দুই বেলার দুই চালকের পকেটে দৈনিক বাড়তি ২০০ টাকা থাকত। এতে তাঁদের পরিবার আরেকটু ভালো থাকার, ভালো খাওয়ার সুযোগ পেত।