কপ২৬: সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমনকারী দেশগুলো কি কথা রেখেছে?

  • রিয়ালিটি চেক টিম
  • বিবিসি নিউজ
চীন বিদ্যুতের জন্য ব্যাপকভাবে কয়লার ওপর নির্ভরশীল

ছবির উৎস, Reuters

ছবির ক্যাপশান, চীন বিদ্যুতের জন্য ব্যাপকভাবে কয়লার ওপর নির্ভরশীল

পৃথিবীর বাতাসে যত কার্বন ডাই অক্সাইড মিশছে, তার অধিকাংশই আসছে মাত্র চারটি দেশ থেকে - চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও রাশিয়া। সাথে আছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন।

প্যারিসে ২০১৫ সালের সম্মেলনে এরা সবাই একমত হয়েছিল - বিশ্বের তাপমাত্রার বিপজ্জনক বৃদ্ধি ঠেকাতে তারা কার্বন নির্গমন কমাবে।

কিন্তু এখন পর্যন্ত কী পদক্ষেপ নিয়েছে তারা?

কোন দেশ কত বেশি কার্বন নির্গমন করছে

চীন: বিশ্বের সর্ববৃহৎ কার্বন নির্গমনকারী

  • চীন বলছে, তাদের কার্বন নির্গমন সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছাবে ২০৩০ সালে
  • দেশটির লক্ষ্য, ২০৩০ সালের মধ্যে তাদের শক্তি উৎপাদনের ২৫ শতাংশ আসবে ফসিলজাত নয় এমন জ্বালানি থেকে
  • চীন অঙ্গীকার করছে, ২০৬০ সালের মধে তারা 'কার্বন-নিরপেক্ষ' হবে।

চীন হচ্ছে সবচেয়ে বড় কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমনকারী, পৃথিবীর সমগ্র নির্গমনের এক চতুর্থাংশই আসছে চীন থেকে। প্রধানত কয়লা নির্ভরতার কারণে তাদের কার্বন নির্গমন এখনো বাড়ছে।

চীন যে কার্বন-নিরপেক্ষ হবার কথা বলছে - তা কি নির্গমন কাটছাঁটের মাধ্যমে অর্জিত হবে, নাকি অন্য কোন পন্থায় হবে - তা তারা এখনো স্পষ্ট করেনি।

গত মাসেই প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ঘোষণা করেছেন যে তারা বিদেশে আর কোন নতুন কয়লাভিত্তিক প্রকল্পে অর্থায়ন করবেন না।

কিন্তু দেশের ভেতরে কয়লাখনিগুলোকে আদেশ দেয়া হয়েছে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য - যাতে চীন জ্বালানির ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে পারে, যদিও তারা ২০২৬ সাল থেকে কয়লার ওপর নির্ভরতা কমানোর অঙ্গীকার করেছে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে অগ্রগতি ঘটিয়েছে চীন। পৃথিবীতে এখন যত সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে তার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি হচ্ছে চীনে, আর বায়ুচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদনে চীন এখন পৃথিবীতে এক নম্বর।

আরও পড়তে পারেন:

চীনের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র

কিন্তু চীনকে যদি তার জলবায়ু সংক্রান্ত লক্ষ্য অর্জন করতে হয়, তাহলে তাকে ২০৬০ সালের মধ্যে কয়লার চাহিদা ৮০ শতাংশেরও বেশি কাটছাঁট করতে হবে - বলছে আন্তর্জাতিক এনার্জি এজেন্সি।

জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে কোন দেশ কি করছে -তার ওপর নজরদারির প্রতিষ্ঠান 'ক্লাইমেট এ্যাকশন ট্র্যাকার' বলছে - চীনের এসব নীতি ও পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। তারা বলছে, অন্য দেশগুলোও যদি একই পথ অনুসরণ করে তাহলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি বেড়ে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্র: মাথাপিছু কার্বন নির্গমন সবচেয়ে বেশি যে দেশের

  • যুক্তরাষ্ট্র ২০৩০ সালের মধ্যে ২০০৫-এর স্তরের অর্ধেক কার্বন ডাইঅক্সাইড কাটছাঁট করবে।
  • দেশটি চাইছে ২০৩০ সালের মধ্যে সেখানে নতুন গাড়ির অর্ধেকই হবে বৈদ্যুতিক গাড়ি।
  • যুক্তরাষ্ট্র অঙ্গীকার করেছে যে ২০৫০ সালের মধ্যে তারা কার্বন-নিরপেক্ষ হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি ব্যবহার

যুক্তরাষ্ট্রে ফসিলজাত জ্বালানি হচ্ছে ৮০ শতাংশেরও বেশি শক্তির উৎস। যদিও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের পরিমাণ এখন বাড়ছে।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পরিবেশসংক্রান্ত পরিকল্পনা সবুজ জ্বালানির আওতা আরো বৃদ্ধি করছে। অন্তত ১৫ হাজার কোটি ডলারের ক্লিন ইলেকট্রিসিটি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে - যা দিয়ে ফসিল জ্বালানি পরিত্যাগকারী কোম্পানিগুলোকে পুরস্কৃত করা হবে।

কিন্তু কিছু মার্কিন আইনপ্রণেতা এতে বাধা দিচ্ছেন - যারা উদ্বিগ্ন যে এ কর্মসূচি কয়লা ও ফ্র্যাকিং শিল্পের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে।

গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রের কার্বন নির্গমন কমতে শুরু করেছে। কিন্তু ক্লাইমেট এ্যাকশন ট্র্যাকার বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও কর্মসূচিগুলো "যথেষ্ট নয়", এবং প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য অনুযায়ী বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রিতে সীমিত রাখতে হলে "এতে আরো উন্নতি ঘটাতে হবে।"

ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন: নির্গমন কমছে

  • ইইউ অঙ্গীকার করেছে ১৯৯০-এর স্তর থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন ৫৫ শতাংশ কমানো হবে।
  • ইইউ লক্ষ্য স্থির করেছে যে ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ জ্বালানি আসবে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে
  • ইইউ ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন-নিরপেক্ষ হবে

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে সবচেয়ে বড় কার্বন নির্গমনকারী দেশগুলো হচ্ছে জার্মানি, ইতালি এবং পোল্যান্ড।

কার্বন নির্গমন কমানোর জন্য ইইউ'র একটি সার্বিক লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এর সদস্য দেশগুলোর আর্থিক এব কারিগরী সক্ষমতা এক রকম নয়।

কিন্তু ইউনিয়নের লক্ষ্য অর্জন করার পন্থাগুলোর ব্যাপারে সব সদস্য দেশকে একমত হতে হবে। কারণ ২০২১ সালের কপ২৬ সম্মেলনে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তার সব সদস্য দেশের পক্ষ থেকে একটি একক সংস্থা হিসেবে দরকষাকষি করবে।

বিবিসি বাংলায় সম্পর্কিত আরো খবর:

ইইউ-তে সবচেয়ে বড় কার্বন নির্গমনকারী হচ্ছে জার্মানি, ইতালি এবং পোল্যান্ড।
ছবির ক্যাপশান, ইইউ-তে সবচেয়ে বড় কার্বন নির্গমনকারী হচ্ছে জার্মানি, ইতালি এবং পোল্যান্ড

ক্লাইমেট এ্যাকশন ট্র্যাকার বলছে, ২০১৮ সাল থেকে ইইউর কার্বন নির্গমন কমছে এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রির নিচে রাখতে ইইউ'র নীতি ও পদক্ষেপসমূহ "প্রায় যথেষ্ট।"

ভারত: কয়লার ওপর নির্ভরশীল

  • ভারতের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে নির্গমনের মাত্রা ৩৩-৩৫% কমিয়ে আনা
  • দেশটি অঙ্গীকার করেছে ২০৩০ সালের মধ্যে তাদের বিদ্যুৎ শক্তির ৪০% আসবে ফসিলজাত নয় এমন জ্বালানি থেকে।
  • 'নেট শূন্য-নির্গমন' অর্জনের কোন লক্ষ্যমাত্রা এখনো ঘোষণা করেনি ভারত

ভারতের বার্ষিক কার্বন নির্গমন গত দুই দশকে অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে ভারতেরই মাথাপিছু কার্বন নির্গমনের মাত্রা সবচেয়ে কম।

ভারত যুক্তি দিচ্ছে যে অপেক্ষাকৃত ধনী এবং অধিক শিল্পোন্নত দেশগুলোকেই নির্গমন কমানোর দায়িত্ব বেশি করে নিতে হবে, কারণ বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এ দেশগুলোই দীর্ঘমেয়াদে সবচেয়ে বেশি ভুমিকা রেখেছে।

এছাড়া ভারত "নির্গমনের মাত্রা" বা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এককপ্রতি কার্বনের একটা লক্ষ্য স্থির করেছে । তারা বলছে, অন্য দেশগুলোর সাথে তাদের তুলনার জন্য এটি একটি অধিকতর ন্যায়সঙ্গত মাপকাঠি।

ভারতের বিদ্যুতের প্রায় ৭০ শতাংশই এখনো কয়লাভিত্তিক
ছবির ক্যাপশান, ভারতের বিদ্যুতের প্রায় ৭০ শতাংশই এখনো কয়লাভিত্তিক

বায়ু, সৌর, এবং জলশক্তিচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাত্রা বাড়ানোরও অঙ্গীকার করেছে ভারত, এবং ২০১৯ সালে এর পরিমাণ ২৩% পৌঁছেছে। কিন্তু ভারতের বিদ্যুতের প্রায় ৭০ শতাংশই এখনো কয়লাভিত্তিক।

ক্লাইমেট এ্যাকশন ট্র্যাকার বলছে, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য তাদেরকে ২০৪০ সালের মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্রমান্বয়ে বন্ধ করতে হবে।

রাশিয়া: অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি তেল ও গ্যাস

  • রাশিয়া ২০৩০ সালের মধ্যে নির্গমন ৩০% কমানোর কথা বলেছে
  • তারা অঙ্গীকার করেছে, ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন-নিরপেক্ষ হবে রাশিয়া।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯১ সালে রাশিয়ার অর্থনীতি ও কার্বন নির্গমন সংকুচিত হয়েছিল। কিন্তু তারা এখনো কার্বন শোষণের জন্য তাদের বিশাল বন ও জলাভূমির ওপর নির্ভর করছে।

রাশিয়ার অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি তেল ও গ্যাস

তাদের জ্বালানির যে অংশটুকু বায়ু, সৌর ও জলশক্তির মত অ-ফসিলজাত উৎস থেকে আসা - তার পরিমাণ বেশ ছোট। অন্যদিকে তাদের জিডিপির ২০ শতাংশেরও বেশি আসে ফসিলজাত জ্বালানি থেকে।

ক্লাইমেট এ্যাকশন ট্র্যাকার বলছে, বিশ্বের তাপমাত্র বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে সীমিত রাখার ক্ষেত্রে রাশিয়ার নীতি ও পদক্ষেপগুলো "একেবারেই যথেষ্ট নয়।"