খেলার মাঠে পাকিস্তান, সর্বনাশ!

গ্যালারিতে বাংলাদেশের জার্সি ও পতাকার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে পাকিস্তানের জার্সি ও পতাকা
ছবি: প্রথম আলো

মিরপুর স্টেডিয়াম কি বাংলাদেশ? সেখানকার খেলার মাঠ কি মুক্তিযুদ্ধের ময়দান? যেন যুদ্ধই অনেকের কাছে। সেই যুদ্ধে বাংলাদেশি নাগরিক কী করে পাকিস্তানের পতাকা ওড়াতে পারে? অতএব তাঁরা বেইমান, গাদ্দার, রাজাকার। একাত্তর সালে কেবল বাঙালি হওয়ার কারণেই, ‘জয় বাংলা’ বলার অপরাধে, স্বাধীনতার পক্ষে থাকার শাস্তি ছিল নির্মম-নির্দয় মৃত্যু। যাঁরা করেছিলেন, তাঁরা পাকিস্তানি ছিলেন না শুধু, বাঙালি রাজাকারেরা তাঁদের সঙ্গে ছিল।

সেই বিবেচনায় পাকিস্তানের ক্রিকেট দলকে পছন্দ করাও তাই অনেকের কাছেই রাজাকারি। পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে সমর্থন করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পতাকা ওড়ানো তাঁদের কাছে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। খেলার মাঠে পাকিস্তানের পতাকা তাঁদের কাছে সর্বনাশের ইঙ্গিত।

সদ্য শেষ হওয়া টি-টোয়েন্টি পুরুষ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের ক্রিকেট দলের কাছে ভারতীয় ক্রিকেট দল শোচনীয়ভাবে হেরে যায়। এতে কারও কারও আনন্দ প্রকাশে হিন্দুত্ববাদী দলগুলি খেপে যায়। ১৪ ভারতীয় নাগরিকের বিরুদ্ধে মামলা করে সে দেশের পুলিশ। মামলাগুলি হয়েছে দেশদ্রোহ ও সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, বিজেপির বিতর্কিত নেতা যোগী আদিত্যনাথ অভিযুক্তদের দেশদ্রোহী হিসেবে বিচার করার অঙ্গীকার করেছেন।

পাকিস্তানের ঘটনাও একই রকম। ২০১৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বিরাট কোহলি ছিলেন অস্ট্রেলিয়াকে পরাস্ত করার নায়ক। এই জয়ের পর উমার দ্রাজ নামের এক দরজি যুবক বাড়ির ছাদে ভারতের পতাকা ওড়ান। পুলিশ তাঁকে সার্বভৌমত্বের ক্ষতি করার অপরাধে অভিযুক্ত করে আটক করে। পরে অবশ্য আদালত উমর দ্রাজকে জামিন দেন। উমরের ভাষ্য হলো, তিনি কেবল বিরাট কোহলির ভক্ত, ভারতের নন।

ভারত-পাকিস্তান ও বাংলাদেশে ক্রিকেট আর খেলা হয়ে নেই। তা হয়ে উঠেছে জাতীয়তাবাদী যুদ্ধ। কেউ বলছেন, খেলার সঙ্গে রাজনীতি মেশাবেন না। কেউ বলছেন, ইতিহাসে যারা একবার শত্রু ছিল, তারা চিরকালই শত্রু—তাদের বিষয়ে কোনো ছাড় নয়। প্রথম পক্ষ খেলার মাঠে তোলা পতাকাকে অরাজনৈতিক মনে করে। দ্বিতীয় পক্ষ ক্রিকেটের মাঠ ও গ্যালারিকে জাতীয়তাবাদী বীরত্ব দেখানোর ময়দান ছাড়া আর কিচ্ছু ভাবতে নারাজ। রাজনীতি যদি রাজনীতির ময়দানে দাঁড়িয়ে না যায়, তখন বেজায়গাতেই তা দেখা দেবে। খেলার সঙ্গে ব্যবসা, ধর্ম, যৌনতা, এমনকি এমপি হওয়াও যখন জড়িয়ে যায়, তখন রাজনীতি কী করে বাদ থাকবে? খেলার সঙ্গে রাজনীতি যদি মেশেই, তাহলে কোন ধরনের রাজনীতি মেশানো উত্তম?

পাকিস্তান ও ভারতবিরোধিতা যে দেশের রাজনীতিতে পাল্টাপাল্টি স্রোত হিসেবে সক্রিয়, সেখানে গ্যালারিতেও তা মুখ দেখাবে। এখন সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত মানুষ যদি জাতীয় দলকে সরকারপক্ষীয় মনে করে সমর্থন করতে ব্যর্থ হয়, তখন উপায় কী!

ব্রিটিশ আমলে ফুটবল ও ক্রিকেটে ব্রিটিশদের পরাজিত করতে পারলে পরাধীন মন সুখী হতো। রাজনৈতিক পরাজয়ের শোধ তুলতে চাইত খেলার জয় দিয়ে। আয়ারল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল ক্রিকেট। অধিপতি সাদাদের যদি অধীন কৃষ্ণাঙ্গরা খেলায় পরাজিত করতে পারে, তাহলে বাস্তবেও তাদের হারানো সম্ভব—এমন আত্মবিশ্বাস জাগানোয় খেলার অবদান ছিল। সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও লিখেছেন, ‘ইস্কুলের মাঠে বাঙালি ও মুসলমান ছাত্রদের “ফুটবল ম্যাচ”।’

অখণ্ড বাংলার কলকাতায় মুসলিমপ্রধান মোহামেডানে যতই হিন্দু খেলোয়াড় থাকুক, তাকে মুসলিম দল হিসেবেই দেখাত আনন্দবাজার পত্রিকা। ২০১৪ সালের এশিয়া কাপে পাকিস্তান ও ভারতীয় দলের হয়ে জয়ধ্বনির গ্যালারিতে ব্যানার ওঠে: যে জন বঙ্গেতে জন্মি হয় ভারতীয়/ পাকিস্তানি সে জন, কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।

পাকিস্তান ও ভারতবিরোধিতা যে দেশের রাজনীতিতে পাল্টাপাল্টি স্রোত হিসেবে সক্রিয়, সেখানে গ্যালারিতেও তা মুখ দেখাবে। এখন সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত মানুষ যদি জাতীয় দলকে সরকারপক্ষীয় মনে করে সমর্থন করতে ব্যর্থ হয়, তখন উপায় কী! খেলার দলকে জাতীয় ভাবা হলে তা এমন নৈতিক ও রাজনৈতিক জটিলতার সৃষ্টি করবেই। দুটি দেশের ২২ জনের খেলাকে কোটি কোটি মানুষের প্রতিযোগিতা বলে ভাবিয়েছে জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র ও গণমাধ্যম। তাদের গায়ে দিয়েছে জাতীয় পতাকার রং, জাতীয় প্রাণীর সৌন্দর্য। জাতীয় সংগীতের পবিত্রতার প্রলেপে মুড়িয়েছে তাদের। এখন চাইলেও ১১ জন ব্যক্তিকে নিছক খেলোয়াড় হিসেবে দেখানো কঠিন।

বাংলাদেশে ভারত ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শক্তিশালী জনমত রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি গণহত্যার পর বাংলাদেশিদের মনে পাকিস্তানের শুদ্ধ-সুন্দর ভাবমূর্তি আঁকা অসম্ভব। অন্যদিকে পানিবঞ্চনা, সীমান্ত হত্যাসহ অজস্র রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে অনেক বাংলাদেশিই ভারতের ব্যাপারে অসন্তুষ্ট ও ভীত। রাজনীতিতে এক পক্ষ অপর পক্ষকে ভারতের বা পাকিস্তানের ‘তল্পিবাহক’ মনে করে। কোন দল কোন দেশের মিত্র, তা–ই দিয়ে দলের চরিত্র বিচার হচ্ছে। যে বাংলাদেশিদের বন্ধু ভারত আর যে বাংলাদেশিদের বন্ধু পাকিস্তান, তারা অপরের নামে কুস্তি লড়ছে।

এ ধরনের জাতীয়তাবাদীরা স্বদেশির মঙ্গলের চেয়ে ভিনদেশির অমঙ্গলে বেশি সুখ পান। এভাবে জাতীয়তাবাদ হয়ে ওঠে চেতনানাশক। ঘৃণা যখন রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রধান মসলা হয়, তখন শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু—এই নিয়ম জয়ী হয়। কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‘অভাবে স্বভাব নষ্ট না হলে, এ জীবন হতো একতিল অধিক বিভোর।’ হয়তো রক্তপাত, শোষণ-বঞ্চনা আর আধিপত্যের অভিজ্ঞতা না থাকলে আমরা খেলাকে খেলা হিসেবে নিতে পারতাম। কিন্তু চলতি সময়ে অযৌক্তিকভাবে হলেও খেলার সঙ্গে রাজনীতি মিশবেই।

একে বুঝতে গেলে দেখব, ক্রিকেট যে হারে সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে, সেই হারে তার ভেতরও ঢুকে পড়েছে পাল্টাপাল্টি জাতীয়তাবাদের পাঞ্জা লড়াই। তাই ‘শত্রু’ দলকে সমর্থনের তলায় কোন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কেন দানা বাঁধছে, তা ভাবা দরকার।

বাস্তবে প্রতিটি জাতীয় দলই কোনো না কোনো কোম্পানির বিজ্ঞাপনী প্রতিনিধি। খেলোয়াড়েরা তাঁদের সাধ্য ও সাধনা দিয়ে আমাদের আবেগ কাড়েন, আর তাঁদের ব্যবহার করে রাষ্ট্র, ব্যবসা ও রাজনীতি।

এটা রোগ নয়, নয় রোগের প্রকাশ। আর রোগটাকে একপক্ষীয় ভাবা মানে নিজের গায়ের দুর্গন্ধ টের না পাওয়া।

যদি বাংলাদেশের ক্রিকেটকে ভালোবাসি, তাহলে ভুল ব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিকীকরণের বিরুদ্ধেই কথা বলার কথা ছিল। দেশের ক্রিকেট অবকাঠামো গতিশীল করা, ক্লাব ও মাঠগুলোকে মাফিয়াদের হাত থেকে বাঁচানোর কথা তোলার দরকার ছিল। দরকার ছিল কর্তাব্যক্তিদের জবাবদিহি দাবি করা। এসব সমস্যা থেকে চোখ বন্ধ রাখানোয় মাখানো হচ্ছে জাতীয়তাবাদী মলম।

মলম পার্টির উগ্র জাতীয়তাবাদ এক দুধারী তলোয়ার। তা যেমন প্রতিপক্ষকে কাটে, তেমনি স্বদেশিকেও আহত করে। পাকিস্তান দলকে যাঁরা সমর্থন করেছেন, তাঁরা নৈতিক ভুল করেছেন। তাঁদের ভুল ভাঙানোর দায়িত্ব প্রকৃত দেশপ্রেমিকেরই। একধরনের ভাইরাস আছে, যা আঘাত পেলে আরও শক্তিশালী হয়। যাঁরা নিজ দেশের হালচালে ত্যক্ত–বিরক্ত, যাঁরা নিজ রাষ্ট্রের দ্বারা অবাঞ্ছিত বোধ করে, আরও আঘাতে তাঁরা আরও দূরেই চলে যাবে এবং শক্তিশালী হবে। বরং আমরা কান পাততে পারি এক ভারতীয়র পরামর্শে।

পাকিস্তান সমর্থনের জন্য কাশ্মীরি ছাত্রদের দেশদ্রোহী বলার বিপক্ষে তিনি দ্য হিন্দু পত্রিকায় চিঠি লিখে বলেন, ‘পাকিস্তানকে সমর্থনের জন্য ওই ছাত্রদের দেশদ্রোহী বলা হবে বুমেরাং। এতে করে তারা আমাদের থেকে আরও বিচ্ছিন্নই হয়ে যাবে। বরং...আমাদের উচিত, তাদের মূলধারায় সম্পৃক্ত করায় কাজ করা, তাদের মন জয় করা।’

হুঁশ ফিরলে দেখা যাবে, পৃথিবীতে জাতীয়তাবাদের যুগ শেষ হয়েছে। যা চলছে, তা বাণিজ্যিক আধিপত্যের লড়াই। খেলা থেকে সিনেমা, ধর্ম থেকে ভ্যাকসিন, সবই সেই লড়াইয়ের বিনিয়োগমাত্র। যে জাতীয়তাবাদ জাতির অধিকাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতে ব্যর্থ, সেই বহুরূপী বর্ণচোরা ক্রিকেটের জার্সি গায়ে জাতির প্রতিনিধি সেজে বসেছে। বাস্তবে প্রতিটি জাতীয় দলই কোনো না কোনো কোম্পানির বিজ্ঞাপনী প্রতিনিধি। খেলোয়াড়েরা তাঁদের সাধ্য ও সাধনা দিয়ে আমাদের আবেগ কাড়েন, আর তাঁদের ব্যবহার করে রাষ্ট্র, ব্যবসা ও রাজনীতি।

এটা ঠিক, কোনো দেশের জাতীয় ক্রিকেট দল যখন সে দেশের পতাকা, জাতীয় সংগীত বহন করে, তখন সেই দলের জয়-পরাজয় খোদ রাষ্ট্রেরই জয়-পরাজয় বলে ভাবার সুযোগ থাকে। এই সুযোগ নিয়েই খেলা আমাদের সঙ্গে ছলনা করে। জনগণ যেখানে সত্যিকারভাবে পরাজিত হয়, এক দেশ যেখানে আরেক দেশকে ছক্কা মেরে বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়ে দেয়, আন্তর্জাতিক মোড়লদের অন্যায় আম্পায়ারিংয়ে যখন বঞ্চিত হয় দুর্বল দেশ, তখন যদি এমন দেশপ্রেম দেখা যেত, বড় ভালো হতো। বরং আমরা দেখি, খেলার জয়ের আনন্দে বিভোর মন দেশের বাস্তব সমস্যায় সাড়া দেয় না।

খেলা অনেকের কাছেই একধরনের আফিম, কঠিন বাস্তবতা থেকে মন সরিয়ে রাখার চোরাই জানালা। আর আমরা এই চোরা জানালার আকর্ষণে ঘর-বাড়ি-দরজা লুট হওয়াটাও ভুলে থাকি। ক্রিকেট নিয়ে রাজনৈতিক বিবাদের এটাই লাভ, এটাই ক্ষতি।

আশির দশকে বাংলাদেশে ভারত ও পাকিস্তান দলের বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল। কারণ, তখন বাংলাদেশ দলের সুনাম ছিল না। গত দুই দশকে ভালো খেলার টানে আমাদের দর্শকেরা দেশমুখী হয়েছন। বাংলাদেশের খেলা পড়ে গেলে আবার তারা ভারত-পাকিস্তান করবে। যদি দেশকে ভালোবাসি, তাহলে ঘৃণা দিয়ে নয়, যোগ্যতা দিয়েই দেশের মানুষকে দেশমুখী রাখা যাবে। জাতীয়তাবাদী জিগির দিয়ে যোগ্যতার উনিশ-বিশ করা যায় না।

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]