শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও নিরাপদ নয় মেয়ে শিক্ষার্থীরা

রাজধানীর একটি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে সুমাইয়া (ছদ্মনাম)। কয়েক মাস আগে কোনো কারণ ছাড়াই নিজের শ্রেণিকক্ষে অন্য সহপাঠীদের সামনে সে নিগ্রহের শিকার হয়। তখন টিফিনের সময়। হঠাৎ শ্রেণিকক্ষে এসে হাজির হন ক্লাসেরই এক শিক্ষক। কথার ফাঁকে তিনি সুমাইয়াকে বলেন, ‘তুমি কি সিনেমার শুটিং করতে এখানে আসো। এভাবে চলাফেরা কেন তোমার?’ শিক্ষকের কথায় অপমানে মেয়েটি স্তম্ভিত হয়। আগেও একাধিক ছাত্রীকে এভাবে কটুকথা বলেছেন ওই শিক্ষক। সুমাইয়া এ ঘটনা বাড়িতে বললে তার বাবা স্কুল কর্তৃপক্ষকে ঘটনাটি জানান। স্কুল কর্তৃপক্ষ শিক্ষককে মৌখিকভাবে সতর্ক করে দেয়।

অনেক মেয়ে শিক্ষার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহিংসতা ও হয়রানির শিকার হয়
অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

সুমাইয়ার বাবা বলছিলেন, ‘আমরা অভিভাবকেরা সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চাই। কিন্তু সেখানেই তাদের নিরাপত্তা থাকে না। এটা একটা অরাজকতা।’

শিক্ষকের কাছে হেনস্তার শিকার হয়ে অন্তত পরিবারের কাছ থেকে সহানুভূতি পেয়েছে সুমাইয়া। সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের রুমকি (ছদ্মনাম) তা–ও পায়নি। স্কুলে শিক্ষকের নিগ্রহের কথা বাড়িতে বলে উল্টো নিজেই গালিগালাজের শিকার হয় সে। সুমাইয়া ও রুমকির মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহিংসতা ও হয়রানির শিকার হয় অনেক শিক্ষার্থী। এসব নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে কাউকে কিছু বলতেও পারে না তারা। শুধু পুরুষ শিক্ষক নয়, তাদের হেনস্তাকারীদের মধ্যে সহপাঠী থেকে শুরু করে নারী শিক্ষকও রয়েছেন। অথচ বিপদে তাঁদেরই হওয়ার কথা ছিল মেয়ে শিক্ষার্থীদের আশ্রয়স্থল।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৭৪ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহিংসতা ও হয়রানির শিকার হয়। সম্প্রতি ‘সহিংসতার ভয়, আর নয়’ শীর্ষক আলোচনায় গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র ও জনপরিসরে সহিংসতা ও হয়রানির শিকার হওয়া মেয়েশিশু ও নারীদের অবস্থা জানতে গবেষণাটি করা হয়।

গবেষণায় ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী ২ হাজার ২৩২ জন শিশু ও নারী অংশ নেন। বিভাগগুলোর মধ্যে খুলনায় এই হার সবচেয়ে বেশি, ৮৯ দশমিক ৭ শতাংশ। এরপরই রয়েছে বরিশাল, ৮০ শতাংশ। আর রাজশাহীতে হয়রানির শিকার হয়েছে ৭৮ দশমিক ৮ শতাংশ।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হয়রানির নানা ধরন আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১১ শতাংশ শিক্ষার্থী জানায়, পুরুষ শিক্ষকদের দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছে তারা। এরপরই রয়েছে সহপাঠী ছেলে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে শারীরিক নিগ্রহ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছেলে সহপাঠী বা সিনিয়রদের কাছ থেকে মুঠোফোনে আপত্তিকর মেসেজ পেয়েছে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। পুরুষ শিক্ষকদের যৌন হয়রানির শিকার হয় ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ছাত্রী। আর শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ করেছে ২১ দশমিক ৩ শতাংশ সহপাঠী। পুরুষ ও নারী উভয় শিক্ষকের কাছে থেকে কটুকথাও শুনতে হয় মেয়ে শিক্ষার্থীদের।

এসব নিগ্রহের প্রভাব শিক্ষার্থীদের কর্মকাণ্ডের ওপরও পড়ে। হয়রানির কারণে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী। বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেয় ৬ দশমিক ২ শতাংশ, পড়ালেখা ছেড়ে দেয় ৯ দশমিক ৬ শতাংশ ও অসুস্থ হয়ে পড়ে প্রায় ১১ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী। আর ৯০ শতাংশের ওপরে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

এতসব হয়রানি নীরবে মেনে নেয় প্রায় ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। ৩১ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী জানায়, তারা শিক্ষকদের কাছে অভিযোগ করে। ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে মা-বাবার কাছে অভিযোগ করে।

হয়রানির শিকার হতে পারে, এই ভয়ে ৫৪ শতাংশ বাবা তাঁর মেয়েকে কোচিং বা প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়তে দিতে চান না। অন্যদিকে ৬২ শতাংশ মা তাঁর মেয়েকে স্কুলের পিকনিকে পাঠাতে চান না। গবেষণায় দেখা গেছে, ৪৮ শতাংশ মা তাঁর মেয়েকে স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে দিতে চান না। ৩৮ শতাংশ ক্ষেত্রে মা তাঁর মেয়েকে স্কুলের কোনো বার্ষিক অনুষ্ঠানে যেতে দিতে চান না।

স্কুলে অভিযোগ শোনা ও প্রতিকারের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো যদি থাকে, তবে হয়রানি ও নিগ্রহের পরিমাণ কমতে পারে। অন্তত বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) কাজের অভিজ্ঞতা তা–ই বলে। দেশের ৫ জেলার ২০টি স্কুলে কাজ করে আসক। জেলাগুলো হলো গাইবান্ধা, কিশোরগঞ্জ, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ ও নওগাঁ। আসকের পরিচালক (কর্মসূচি) নীনা গোস্বামী বলেন, ‘যেসব স্কুলে আমরা কাজ করি, সেসব স্কুলে হয়রানির পরিমাণ আশাতীতভাবে কমেছে। অভিযোগ শোনার ব্যবস্থা থাকার কারণেই এটা হয়েছে বলে আমার ধারণা।’

আসক জাতীয়ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা অভিযোগ গ্রহণ করে। তাদের কাছে আসা অভিযোগের মধ্যে একটি অংশ স্কুলে শিক্ষার্থীদের হয়রানি বা নিগ্রহ–সংক্রান্ত। মূলত রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলে পড়া শিক্ষার্থীদের মা-বাবা এসব অভিযোগ করেন। আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিযোগ আসে স্কুলের পুরুষ শিক্ষকদের বিরুদ্ধে, জানালেন নীনা গোস্বামী। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা মা–বাবাকে এসব অভিযোগ করে, আর তাঁরা আমাদের কাছে আসেন। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে মেয়েদের চলাফেরায় আরও কড়াকড়ি আরোপ করেন অভিভাবকেরা।’

বেসরকারি সংগঠন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের জেন্ডার বিশেষজ্ঞ বনশ্রী মিত্র মনে করেন, যারা হয়রানি বা নিগ্রহের ঘটনা ঘটায়, তারা পরিবারেও একই কাণ্ড করে। আর এসব কর্মকাণ্ডকে ছোট করে দেখার বা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা দেওয়ার প্রবণতা সমাজে আছে। এই গ্রহণযোগ্যতা তৈরির প্রচেষ্টা ভাঙতে হবে। নিগ্রহ কমাতে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিটি থাকার কথা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তা থাকে না বলে মন্তব্য করেন বনশ্রী মিত্র। এসব কমিটি গঠন নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারি তৎপরতার ওপর জোর দেন তিনি।