আরও দুর্বল টাকা, ডলারের দাম ঠিক করবে ‘বাজার’

দাম নিয়ে বেকায়দায় পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। না পারছে বাজারকে মেনে নিতে, না পারছে ডলারের চাহিদা মেটাতে।

ডলারের সংকট কাটাতে এবার এক দিনেই দুই সিদ্ধান্ত দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলারের যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল, তা তুলে নিয়েছে। ডলারের দামকে বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। তবে এই বাজারের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখবে, করবে নিয়ন্ত্রণও। ফলে ডলারের দাম পুরোপুরি জোগান ও চাহিদার ওপর নির্ভর করবে না।

পাশাপাশি ডলারের বিপরীতে টাকার মান ৯০ পয়সা কমানো হয়েছে। ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে ডলারের দাম বেড়ে হয়েছে ৮৯ টাকা ৯০ পয়সা। এই দামেই গতকাল বৃহস্পতিবার ১৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

গতকাল সকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ব্যাংকগুলোকে জানিয়ে দেওয়া হয়, বাজারের সঙ্গে সংগতি রেখে ব্যাংকগুলো নিজেরাই ডলারের দাম নির্ধারণ করতে পারবে। তবে হঠাৎ যেন ডলারের দাম বেশি বাড়িয়ে না ফেলা হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। পাশাপাশি বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো যাতে দাম বেশি বাড়াতে না পারে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে বলা হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দাম ৮৯ টাকা ২০ পয়সা নির্ধারণ করলেও বাস্তবে ব্যাংকগুলোতে ডলারের দাম ছিল আরও বেশি। গতকাল ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয়ে ৯২-৯৪ টাকা পর্যন্ত দাম দিয়েছে। ফলে আমদানিকারকদের আরও বেশি দামে ডলার কিনতে হয়েছে। সামনের দিনে তা আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন ব্যাংকাররা। এর ফলে বাড়বে আমদানি ব্যয়, যার প্রভাব পড়বে পণ্যের দামে। আরও বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের দাম এভাবে বেঁধে দেওয়াটা কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। কারণ, এটার ফল ভালো হয় না। যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযথ চিন্তাভাবনা করা উচিত। এখন সংকট কাটাতে আমদানিতে লাগাম টানতে হবে। কী আমদানি হচ্ছে, তা তদারকি করতে হবে। প্রয়োজনে কিছু পণ্য আমদানি বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে।

সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, রপ্তানি আয় যারা ধরে রেখেছে বা দেশে আনেনি, তা আনার ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য সরকারি অন্য সংস্থাগুলোকে সক্রিয় করতে হবে। আর কারা খোলাবাজার থেকে এত ডলার কিনল, তার তথ্য সংগ্রহ করে অভিযান জোরদার করতে হবে।

ডলার-সংকট কেন

আমদানি পণ্যের দাম ও জাহাজভাড়া বেড়ে যাওয়ায় ইতিমধ্যে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে প্রায় ৪৪ শতাংশ। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় দিয়ে সেই খরচ মেটানো যাচ্ছে না। এতে ডলারের সংকট তৈরি হয়েছে, বেড়ে গেছে দাম। সংকট সামলাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায়, ব্যাংকে ডলারের দাম ৯৭ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক দীর্ঘ সময় ধরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান যাতে খুব কমে না যায়, তা নিয়ে সচেষ্ট ছিল। আবার এখন সরকারের পক্ষ থেকে ডলারের দাম ৯০ টাকার ওপরে না নেওয়ার অলিখিত নির্দেশনা রয়েছে। ফলে ডলারের দাম নিয়ে একরকম বেকায়দায় পড়ে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। না পারছে বাজারকে মেনে নিতে, না পারছে ডলারের চাহিদা মেটাতে।

এমন পরিস্থিতিতে গত রোববার ডলারের দামের সীমা বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এই দামে বৈধ পথে প্রবাসী আয় আসা কমে যায়। কারণ, ব্যাংকে পাঠালে প্রতি ডলারের বিপরীতে মিলছিল ৮৯ টাকা ২০ পয়সা, অবৈধ পথে ৯৫ টাকা। পাশাপাশি রপ্তানিকারকেরা বেশি দামের আশায় বিল নগদায়ন কমিয়ে দেয়। এতে ব্যাংকগুলোতে সংকট প্রকট হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি এমন হয়, কয়েকটি ব্যাংক আমদানি দায় শোধ করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার পায়নি, অন্য ব্যাংক থেকেও কিনতে পারেনি। অনেক ব্যাংক আমদানি বিল পরিশোধে বাড়তি সময় নিয়েছে।

গতকাল যা হলো

ডলারের দামের সীমা বেঁধে দেওয়ার প্রভাব জানাতে গত বুধবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন। জানা গেছে, এ সময় সংকট বাড়ার বিষয়টি জানানো হয়। তাতেই ডলারের দামের সীমা তুলে দেওয়ার বিষয়ে একমত পোষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এরপর গতকাল ব্যাংকগুলোকে জানিয়ে দেওয়া হয়, প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম নির্ধারিত হবে বাজারমূল্যে। তবে বাজারে তদারকি জোরদার করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যাতে কেউ কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাড়তি মুনাফা করার সুযোগ না পান।

প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম বাজারমূল্যে নির্ধারিত হওয়ায় আমদানিতেও একইভাবে ডলারের দাম নির্ধারণ করা হবে। পাশাপাশি রপ্তানি আয় নগদায়ন হবে বাজারমূল্যে। ব্যাংকগুলো যে দামে ডলার কিনবে, বিক্রি করবে তার চেয়ে কিছু বেশি দামে।

এই সীমা তুলে দেওয়ার পর গতকাল কোনো কোনো ব্যাংক প্রবাসী আয় সংগ্রহে প্রতি ডলারের জন্য ৯৪ টাকা দাম দেয়। যদিও আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি ডলারের জন্য সর্বোচ্চ ৮৯ টাকা ২০ পয়সা নির্ধারণ করে দিয়েছিল। ডলারের দামের পরিস্থিতি কী হয়, তা বোঝা যাবে আসছে সপ্তাহে।

এখন ডলারের দাম বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়ার পাশাপাশি তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি সরকারি পর্যায়েও বাস্তবতা বুঝিয়ে ৯০ টাকার ওপরে নেওয়ার অনুমতি পেতে চায়।

গতকালই ডলারের দাম ৯০ পয়সা বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে গত সোমবার একবারেই ১ টাকা ১০ পয়সা বাড়ানো হয়েছিল। টাকার আরেক দফা অবমূল্যায়নের ফলে আমদানি খরচ আরও বাড়বে। অন্যদিকে রপ্তানিকারকেরা লাভবান হবেন। সাধারণত রপ্তানিকারকদের সুবিধা দিতেই স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন করতে হয়। তবে এখন বাংলাদেশকে এই পথে যেতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ৮৯ টাকা ৯০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করা হয়েছে, আগে যা ছিল ৮৯ টাকা। ডলারের দামের সীমা তুলে নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ব্যাংকের মাধ্যমে তথা বৈধ পথে প্রবাসী আয় কমে যাচ্ছে। এ জন্য প্রবাসী আয় আনার ক্ষেত্রে ডলারের কোনো নির্দিষ্ট দাম থাকছে না। ব্যাংকগুলো বাজারের সঙ্গে সংগতি রেখে ও চাহিদা বিবেচনায় ডলারের দাম ঠিক করবে।

প্রভাব কী

বাজারের ওপর ডলারের দাম ছেড়ে দেওয়ায় সাময়িক সময়ের জন্য বেড়ে যাবে। এতে বাড়বে আমদানি খরচ, যার প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতিতে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কৃত্রিমভাবে বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করবে। সরকারি আমদানির পাশাপাশি খাদ্যপণ্য আমদানির জন্য ডলার বিক্রি করবে। পাশাপাশি ডলারের সরবরাহ বাড়াতে উদ্যোগ নেবে। এতে একসময় সংকট কেটে যাবে বলে আশা করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের দাম ধীরে ধীরে সমন্বয় করলে ভালো। এতে রপ্তানি আয় বাড়বে, আমদানিতেও বড় চাপ তৈরি হবে না। এই মুহূর্তে জাতীয় স্বার্থে ব্যাংকগুলোর এই খাত থেকে মুনাফার চিন্তা না করাই ভালো হবে। যাঁরা বিদেশে সম্পদ পাচার করেছেন, সংকট কাটাতে তাঁরা এগিয়ে আসবেন না। যাঁরা কষ্ট করে বিদেশে গেছেন, তাঁদের আয় কাজে দেবে। এ জন্য প্রবাসী আয়ে প্রণোদনা সাময়িক সময়ের জন্য বাড়ালে সংকট কিছুটা কাটবে।