তরুণদের বিসিএসমুখিতা এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশসহ বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তদের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে গিয়ে। অন্যদিকে ডলার-রুবলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের টাকার মান নিম্নমুখী।

বাংলাদেশে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি টাকার দরপতন ঘটেছে। একই সঙ্গে আমদানি ও রপ্তানির মধ্যকার ক্রমবর্ধমান ফারাক, রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাওয়া, বিদেশি লোনের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বেড়ে যাওয়া, বিদেশে অর্থ পাচার, বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি ও ধীরগতিসহ নানা সংকট দেশের অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। কেউ কেউ সম্প্রতি দেউলিয়া বনে যাওয়া ‘শ্রীলঙ্কা’ নামক নব্য জুজুর ভয় দেখাচ্ছে, কেউ কেউ অবশ্যই এই শ্রীলঙ্কা–ফোবিয়াকে পাত্তাই দিচ্ছে না। তবে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি কখনো হবে না—এটা ঠিক নয়। শ্রীলঙ্কা উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ ছিল। যেখানে বাংলাদেশ সবে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের শর্ত পূরণ করেছে। অর্থাৎ শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়া অবাস্তব কিছু নয়। তবে আপাতত তেমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা খুব ক্ষীণ আমাদের।

কিন্তু দেশ যে অবস্থায়ই থাক না কেন, দেশে বিসিএস চাকরিসহ সরকারি কেরানি বা ক্লার্ক হওয়ার উন্মাদনায় কোনো ভাটা পড়েনি। যেন সম্প্রতি আসাম-সিলেটের বন্যার মতো গণ–উন্মাদনা চলছে প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরির বাজারে। মানুষ যেন বন্য-হন্যের মতো খুঁজছে সরকারি চাকরি। বলা বাহুল্য সঠিকভাবে দেশ পরিচালনার জন্য বিসিএস চাকরিতে মেধাবীদের আগ্রহ ও অংশগ্রহণ খুব দরকার। তবে বর্তমানে যে দুর্দমনীয় আগ্রহ-উদ্দীপনা চলছে, তা জাতির জন্য মোটেও শুভকর নয়।

মনে রাখতে হবে, আমাদের সামনে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ। আগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শুধু প্রশাসক নয়; দরকার মেধাবী বিজ্ঞানী, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারের। বিসিএস বা প্রশাসনিক চাকরি নিয়ে কিছুটা নেতিবাচক কথা কারও কারও গাত্রদাহের কারণ হতে পারে। কেউ কেউ মনে করতে পারেন ‘আঙুর ফল টক’। কিন্তু দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা তো একই কথা বলছেন। শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছেন, ‘“বিসিএস বিশ্ববিদ্যালয়” নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হোক। সেখানে “প্রিলিমিনারি পরীক্ষা”, “ভাইভা” ইত্যাদি নামে বিভাগ থাকবে। দারুণ চলবে কিন্তু।’ তার কথার বাস্তব প্রতিফলন চোখে পড়ে উচ্চশিক্ষা অঙ্গনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন লাইব্রেরিতে এখন মৌলিক বই পড়ার শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে ভোর থেকেই চেয়ার-টেবিল দখলের ব্যাগের বিশাল লাইন পড়ে যায়। যদি বলা হয়, বিসিএস বা চাকরির প্রস্তুতির বই পড়া যাবে না লাইব্রেরিতে, তবে হাতে গোনা কয়েকজন পাওয়া যাবে।

অর্থ উপার্জনকে নেতিবাচকভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু টাকা যদি আয় হয় মেধা বিবর্জিতভাবে, তবে সেটা ঘোরতর বিপত্তি। কারণ, এটা সমাজকে ভুল বার্তা দেয়। এখন উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েরা ইউটিউব, ফেসবুককেন্দ্রিক সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ হয়তো সফলতা দেখাচ্ছে; কিন্তু তা অত্যন্ত কম সংখ্যায়। এ ক্ষেত্রে অধিকাংশই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে মাদকাসক্তসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে সমাজ এখন একটা ফ্লেভারমাত্র। আর সামাজিক গণমাধ্যম সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনকারী ব্যক্তিদের কাছে বড্ড অসহায়।

আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে ঘুরতে আসা একজন পর্যটক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইব্রেরিতে শিক্ষার্থীদের ভিড় দেখে বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা এত লেখাপড়া করে?’ কিন্তু তিনি জানেন না, তারা গুগল, ইন্টেল, নাসার বিজ্ঞানী কিংবা প্রযুক্তিবিদ হতে লেখাপড়া করছে না। তারা লেখাপড়া করছে বিসিএস চাকরিপ্রাপ্তির জন্য। সত্যিই এই দৃশ্য যদি মৌলিক পাঠ ও গবেষণার জন্য হতো, তবে দেশ দ্রুত বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গ, ইলন মাস্ক কিংবা সুন্দর পিচাইয়ের মতো গুণী ও দক্ষ লোক পেয়ে যেত। আমরা পাচ্ছি প্রশাসক, সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়া ইউটিউবার, ফুড ব্লগার অথবা ফেসবুক সেলিব্রিটি। যাদের অনেকে দেশের জন্য ‘টিউমারে’ পরিণত হয়েছে। হু হু করে বাড়ছে তাদের ফ্যান-ফলোয়ার।

কিছু ছেলেমেয়ের ইউটিউবে ফুড রিভিউ ও পণ্যের ফেসবুক মার্কেটিং দেখলে মনে হয়, তারা বিশ্বের সেরা কুক বা উপস্থাপক। অথচ তাদের ভাষাজ্ঞান ও উপস্থাপন অত্যন্ত নিম্নমানের ও অশোভনীয়। তাদের ওভার অ্যাক্টিংয়ের (অতি–অভিনয়) কথা না-ই বললাম। অথচ ফেসবুক ব্যবহারকারীরা তাদের পেজে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। এই সুযোগ ব্যবহার করে তারা নানা পণ্যের মার্কেটিং করে লাখ লাখ টাকা কামাচ্ছে। অর্থ উপার্জনকে নেতিবাচকভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু টাকা যদি আয় হয় মেধা বিবর্জিতভাবে, তবে সেটা ঘোরতর বিপত্তি। কারণ, এটা সমাজকে ভুল বার্তা দেয়। এখন উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েরা ইউটিউব, ফেসবুককেন্দ্রিক সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ হয়তো সফলতা দেখাচ্ছে; কিন্তু তা অত্যন্ত কম সংখ্যায়। এ ক্ষেত্রে অধিকাংশই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে মাদকাসক্তসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে সমাজ এখন একটা ফ্লেভারমাত্র। আর সামাজিক গণমাধ্যম সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনকারী ব্যক্তিদের কাছে বড্ড অসহায়।

শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন কিছু প্রবর্তন করতে হলে অনেক ভাবনাচিন্তা বা পরীক্ষা–নিরীক্ষা অতীব জরুরি। তবে এ দেশে কিছু ক্ষেত্রে খুব সহজে শিক্ষা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তা কোনো রকম বাছবিচার ছাড়া কার্যকর করা হচ্ছে। আমাদের এই ছোট্ট দেশে নির্বিচারে একের পর এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে, যা আত্মঘাতী বলেই সচেতনমহল মনে করছে। এ বিষয়ে সরকারের আরও ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে, যেখানে মানসম্মত শিক্ষাবিস্তারে সরকারের দায়বদ্ধতা সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে ছাত্রছাত্রীর দিক দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ অনার্স প্রথম বর্ষ ভর্তি–সংক্রান্ত একটা সিদ্ধান্ত সবাইকে হতবাক করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা পরিস্থিতি ও মান বিবেচনায় আকাশচুম্বী করা হয়েছে। এখন থেকে কোনো শিক্ষার্থী ন্যূনতম এসএসসি ও এইচএসসির সিজিপিএ ৩.০০ বা প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ না হয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না। সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, এসএসসি ও এইচএসসিতে সিজিপিএ ৩.০০ পেলে তা প্রথম শ্রেণি হিসেবে গণ্য করা হয়।

একাডেমিকভাবে দ্বিতীয় শ্রেণির রেজাল্ট নিয়ে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট, ফরেন ক্যাডারে চাকরি করা যাবে; কিন্তু এসএসসি ও এইচএসসিতে দ্বিতীয় শ্রেণি পেলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যাবে না, এটা একটি তুঘলকি কাণ্ড ছাড়া কিছু না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আর একটি আজব কর্মকাণ্ড—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আগেই তারা নতুন ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষে ভর্তির সার্কুলার দিয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে, যা বিগত দিনে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেলেই কেবল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করত। যা সর্বজনগ্রাহ্য ছিল। এই দুই-তিন বছরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি অর্জন করে ফেলল যে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে সবার আগে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে? এই হঠকারী সিদ্ধান্ত কার স্বার্থে? এটা শিক্ষার্থীদের স্বার্থে, না বুর্জোয়াদের স্বার্থে? অনেক শিক্ষার্থী ও সচেতনমহলের দাবি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ভর্তি বাণিজ্যের সুযোগ করে দেওয়ার জন্যই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কথা যদি সত্য হয়, তবে জাতির জন্য এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়। বিষয়টি সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে খতিয়ে দেখা উচিত। যেহেতু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কম খরচে গরিব ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা অর্জনের শেষ আশ্রয়স্থল বলে বিবেচিত।

উল্লেখ্য, সরকারিভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে গৃহীত নানা উদ্যোগ দেশের শিক্ষার হার বৃদ্ধি, রেজাল্ট সুসমৃদ্ধ হয়েছে—এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে যারপরনাই প্রশ্ন রয়ে গেছে। এখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত উপচার্য বা সহ-উপাচার্যরা বাস্তবতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকেন না। তিনি একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভিসি হন। তাই তাঁর ভেতর দায়বদ্ধতার ঘাটতি পরিলক্ষিত হতেই পারে। অপর দিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কোনো কলেজ থেকে যদি অভিজ্ঞ কোনো অধ্যাপক উপচার্য হিসেবে নিয়োগ পান; তবে আশা করা যায় তিনি নিজের বিশ্ববিদ্যালয় মনে করে যত্নসহকারে দায়িত্ব পালন করবেন। শিক্ষার মানোন্নয়নে নানা ভালো উদ্যোগ ও কাজ করার প্রচেষ্টা চালাবেন।

আর একটা বিষয় পরিশিষ্ট আকারে উল্লেখ করা যায় তা হলো, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন নিয়োগপ্রাপ্ত অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি। বলা যায়, তাঁরা দীর্ঘদিন অবহেলিত শ্রেণি হয়ে উচ্চশিক্ষা বিস্তারে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু প্রতিদানে তেমন কিছুই পাচ্ছেন না। তাঁদের অভিভাবকত্ব নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়েছে। তাঁদের নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এক প্রকার বিকর্ষণগত সম্পর্ক। নিয়োগ, চাকরির স্থায়িত্বকরণ, বেতন-ভাতা প্রদানসহ দায়বদ্ধতার প্রশ্ন এলেই এক প্রতিষ্ঠান আরেক প্রতিষ্ঠানের ওপর দায় চাপিয়ে দেয়। সরাসরি কাউকে তাঁদের অভিভাবকত্ব স্বীকার করতে দ্বিধান্বিত দেখা যায়, যা মোটেও শোভনীয় নয়। এমতাবস্থায় এই চাপাচাপি বাদ দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বিত উদ্যোগে অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিও প্রদান করাটা সমীচীন বলে মনে হয়। কারণ, ডিগ্রির ক্ষেত্রে যদি তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষক এমপিওভুক্তির সুযোগ পান, তবে অনার্স-মাস্টার্সের শিক্ষকদের এমপিওপ্রাপ্তি যৌক্তিক ও সময়োপযোগী।

এমন বিষয়গুলোর দিকে যদি সরকারের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ সদয় বিবেচনায় নেয়, তবে শিক্ষাক্ষেত্রে গুণগত উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষয়ের যে বাতাবরণ তৈরি হয়েছে চারপাশে, তা অনেকটা রোধ করা সম্ভব হবে বলে সচেতনমহল মনে করেন।

  • খালিদ ফেরদৌস
    প্রভাষক, সমাজকর্ম, গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট কলেজ