পরিবারের সবাইকে কাছে পেয়ে আমার কী যে ভালো লাগছে!

পটুয়াখালীর গলাচিপার আমখোলা গ্রামের ফিরোজ সিকদার কয়েকজন বন্ধু ও এক ভাগনেকে নিয়ে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে গিয়ে ২৭ মে সাগরে ভেসে যান। একপর্যায়ে তাঁকে উদ্ধার করেন মাছ ধরার ট্রলারের জেলেরা। পরে ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি জাহাজে তাঁকে তুলে দেওয়া হয় এবং তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ভারতের চেন্নাইতে। এত দিন তিনি সেখানেই ছিলেন। ৬ জুন তিনি বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে দেশে ফিরে আসেন। এ নিয়ে প্রথম আলো কথা বলে তাঁর সঙ্গে।

ফিরোজ সিকদার
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

আপনারা কতজন সাগরে গোসল করার জন্য নেমেছিলেন?

ফিরোজ সিকদার: আমার সঙ্গে চার-পাঁচজন বন্ধু ও এক ভাগনে ছিল। আমরা কুয়াকাটায় গিয়েছিলাম বেড়ানোর জন্য। আমরা এই কয়জন মিলে গোসল করতে নেমেছিলাম। সাগরের পানিতে নেমে যে যার মতো হইহুল্লোড়, আনন্দ করছিলাম। প্রায় তিন ঘণ্টা সাগরের পানিতে গোসল করেছি। এক ফাঁকে আমি ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে যাই। অন্যরা বিষয়টা টের পাননি।

প্রশ্ন :

সাগরের পানিতে ভেসে ছিলেন কত সময়? উদ্ধার হলেন কীভাবে?

ফিরোজ সিকদার: আগেই বলেছি আমি হঠাৎ ঢেউয়ের তোড়ে গভীর সমুদ্রে চলে যাই। ৫-৬ ঘণ্টা ভাসার পর একটি কলাগাছ হাতের কাছে পাই। সেটাকে আঁকড়ে ধরে ভাসতে থাকি। এর মধ্যে রাত হয়ে যায়। পরে একটি মাছ ধরার ট্রলারের জেলেরা আমাকে উদ্ধার করেন। রাতে আমাকে ট্রলারে খাবার দেওয়া হয়। আমি ঘুমিয়ে যাই। পরের দিন সকালে ওই ট্রলারের জেলেরা আমার কাছে সবকিছু জানতে চান। তবে তাঁদের ভাষা আমি বুঝতে পারিনি। আমি ইশারায় কিছুটা বোঝাতে চেষ্টা করেছি। এরপর ওই ট্রলারের জেলেরা আরও এক দিন ট্রলার চালিয়ে আমাকে নিয়ে ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি জাহাজে তুলে দেন। ওই জাহাজটি আরও ৫-৬ দিন চালিয়ে নির্ধারিত ঘাটে পৌঁছায়।

প্রশ্ন :

এ কয়দিন আপনি কীভাবে ছিলেন?

ফিরোজ সিকদার: জাহাজ থেকে আমাকে নামিয়ে নিয়ে নৌবাহিনীর সদস্যরা তাঁদের অফিসে নিয়ে যান। সেখানে আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়। তাঁরা হিন্দিতে কথা বলছিলেন। আমি হিন্দি বুঝিনি। তবে বুঝতে পারি, আমি যেখানে আছি সেই জায়গার নাম চেন্নাই। চেন্নাইতে আমি প্রায় তিন দিন ছিলাম।

প্রশ্ন :

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করলেন?

ফিরোজ সিকদার: নৌবাহিনীর সদস্যরা আমাকে দুই হাজার টাকা দিয়েছিলেন। তা দিয়ে আমি মুঠোফোন সেট কিনি। সিম ভরে পরিবারের সঙ্গে কথা বলি। বাড়িতে আসার আগপর্যন্ত আমি ওই ফোন দিয়েই কথা বলেছি। মহিপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) সঙ্গেও কয়েকবার কথা বলেছি।

প্রশ্ন :

বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা কে করল? কীভাবে হলো?

ফিরোজ সিকদার: নৌবাহিনীর লোকেরাই আমাকে দেশে আসার ব্যবস্থা করেছেন। আমার টিকিটের ব্যবস্থা করে কলকাতার উড়োজাহাজে তুলে দিয়েছেন। তাঁরা আমার হাতে টিকিট দেননি। তাঁদের প্রতিনিধি আমাকে উড়োজাহাজে তুলে দিয়েছেন। চেন্নাই থেকে আমি কলকাতায় পৌঁছাই। কলকাতায় এক রাত ছিলাম। কলকাতায় থাকার ব্যবস্থাও স্থানীয় প্রশাসন করেছে। এখান থেকে আমাকে টিকিট কেটে বাংলাদেশগামী ট্রেনে তুলে দেওয়া হয়। ট্রেনে ওঠার আগে আমাকে ৬ হাজার টাকা দেওয়া হয়। আমি পেট্রাপোল এসে পৌঁছার পর একজন আমাকে ট্রেন থেকে নামিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে বেনাপোল চেকপোস্টে নিয়ে যান। সেখানে সব কাজ সম্পন্ন করে আমি বাংলাদেশে ঢুকি।

প্রশ্ন :

পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া আপনি কীভাবে সীমান্ত পেরিয়ে দেশে আসতে পারলেন?

ফিরোজ সিকদার: আমি তো অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করিনি। বিপদে পড়ে ভারতের চেন্নাইতে গিয়ে পৌঁছেছি। এতটুকু বুঝেছি, ভারতীয়রা আমাকে অবৈধ ব্যক্তি হিসেবে শনাক্ত করেনি। তারা আমার প্রতি বিপদগ্রস্ত মানুষ হিসেবে সদয় আচরণ করেছে। আন্তরিক ভালোবাসা দেখিয়েছে, খাতির করেছে। ভারতীয় নৌবাহিনীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় আমি বিশেষ ব্যবস্থায় দেশে আসতে পেরেছি। কলকাতা থেকে বেনাপোল চেকপোস্ট পৌঁছার পর আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় বেনাপোল থানায়। বেনাপোল থানায় আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আমার দেখা হয়।

প্রশ্ন :

এত ঘটনার পর দেশে এলেন, পরিবারের কাছে ফিরলেন, কেমন লাগছে?

ফিরোজ সিকদার: নিজের দেশের মাটির টান কতটা গভীর, এই কয় দিনে আমি বুঝেছি। দেশে এত দ্রুত যে আসতে পারব, তা বুঝিনি। আল্লাহর রহমত আর মানুষের দোয়ায় আমি দ্রুত দেশে আসতে পেরেছি। পরিবারের সবাইকে কাছে পেয়ে আমার কী যে ভালো লাগছে!

আরও পড়ুন