পাচার হয়েছে, তাই ফেরতের চেষ্টা

বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে বেশি প্রশ্ন করা হয় পাচার হওয়া অর্থ ফেরত নিয়ে। অর্থমন্ত্রী এর পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি দেখান।

প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। গতকাল ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে
ছবি: প্রথম আলো

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার হয়েছে। আর এ কারণেই তা ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশ এমন উদ্যোগ নিয়ে সফলও হয়েছে। এসব অর্থ ফেরত আনার ব্যাপারে বাধা না দেওয়ার আহ্বান জানান অর্থমন্ত্রী।

অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বললেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি, সুইস ব্যাংকসহ (সুইজারল্যান্ডের ব্যাংক) বিভিন্ন দেশে যে অর্থ গেছে, তা বাংলাদেশ থেকে যায়নি।’

জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের পরদিন গতকাল শুক্রবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে অর্থ মন্ত্রণালয় আয়োজিত বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা উঠে আসে। সাধারণত এ সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রীদের জন্য সামনের কাতারে এবং আমলাদের জন্য পেছনের কাতারে আসন রাখা হয়। এবার সবার জন্যই ছিল একটি কাতার। ফলে এক টেবিলেই বসেছিলেন মন্ত্রী ও আমলারা।

সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম। এ ছাড়া ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদার, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ ও পরিকল্পনাসচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী।

টাকা পাচার হয়নি, সে কথা বলিনি। তাঁদের (পাচারকারীদের) বিরুদ্ধে মামলা আছে, অনেকেই জেলে আছেন। পাচার হওয়া টাকা মানুষের হক।
আ হ ম মুস্তফা কামাল, অর্থমন্ত্রী

সূচনা বক্তব্য দেওয়ার পর অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের কাছে প্রশ্ন জানতে চান। অর্থমন্ত্রী কোনো প্রশ্নের জবাব নিজে দেন, কোনোটির জবাব দিতে দায়িত্ব দেন অন্য মন্ত্রী ও আমলাদের। কোনো কোনো প্রশ্নের জবাব কেউই দেননি। বাজেট–উত্তর এ সংবাদ সম্মেলন প্রতিবছর দুই ঘণ্টার মতো চলে। এবার দেড় ঘণ্টা পেরোনোর পর থেকেই অর্থমন্ত্রী বারবার ‘শেষ প্রশ্ন, শেষ প্রশ্ন’ বলতে থাকেন।

বিশ্ব অর্থনীতি যে করোনার কারণে প্রবৃদ্ধি হারিয়েছে, তা দিয়ে বক্তব্য শুরু করেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমাদের অর্থনীতির কোনো অঙ্গই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।’ এবারের বাজেট তৈরিতে নতুন নতুন আশা ও সুযোগ বিবেচনা করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এবার জোর দেওয়া হয়েছে আধুনিকায়ন ও প্রযুক্তিতে। আর বড় ভরসার জায়গা হচ্ছে সব শ্রেণির মানুষ। কারণ, একা বা একক কোনো গোষ্ঠী ভালোভাবে কোনো কাজ করতে পারে না।

আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘গরিব হওয়ার কষ্ট আমি বুঝি। নিজে গরিব ছিলাম। আমি জানি, এ থেকে মুক্তি পেতে হলে সবাইকে একসঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে। এ জন্য বাজেটটি করা হয়েছে দেশের সব মানুষের সহায়ক হিসেবে।’ বাজেটে অবশ্য গরিবের ১০ টাকা কেজি দরের চাল ১৫ টাকা করার প্রস্তাব করেছেন তিনি।

অর্থমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন ছিল, ট্রুথ কমিশন করে আগে অনেকের কাছ থেকে অর্থ উদ্ধার করা হলেও পরে আর এ বিষয়ে গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়নি। পাচার করা অর্থ ফেরত আনার বিষয়েও এ রকম ঘটনা ঘটবে কি না। প্রশ্নের জবাব দিতে অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব দেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমকে। তিনি বলেন, ‘আগের বিষয়টি সংসদের প্রতিশ্রুতি ছিল না এবং আইনের মাধ্যমে স্বীকৃত ছিল না। এবার যাঁরা টাকা ফেরত আনবেন, তাঁদের সংসদ অনুমোদিত আইনের মাধ্যমে সুরক্ষা দেওয়া হবে।’

একই বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘সে সময় দেশে সাংবিধানিক সরকার ছিল না। এখন ধারাবাহিক সাংবিধানিক সরকার আছে। ফলে যাঁরা টাকা ফেরত আনবেন, তাঁদের কোনো সমস্যা হবে না।’

বিএফআইইউ দেখেছে, সুইস ব্যাংকসহ বিভিন্ন দেশে যে অর্থ গেছে, তা বাংলাদেশ থেকে যায়নি।
ফজলে কবির, গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

‘টাকা পাচার হয়নি, সে কথা বলিনি’

পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার উদ্যোগের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, বিষয়টি নতুন কিছু নয়। ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশই এটি কার্যকর করেছে। অর্থ পাচার বিভিন্নভাবে হয়। ঘুষ, দুর্নীতির কারণেই যে হয়, তা নয়। পদ্ধতিগত কারণেও হয়।

অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘টাকার একটি ধর্ম আছে। কেউ স্যুটকেসে করে টাকা নিয়ে যায় না। টাকা যেখানে বেশি সুখ পায়, সেখানে চলে যায়। কানাডা, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, নরওয়েসহ বিশ্বের ১৭টি দেশ এভাবে টাকা ফেরত আনার উদ্যোগ নিয়েছে। টাকা পাচার হয়নি, সে কথা বলিনি। তাঁদের (পাচারকারীদের) বিরুদ্ধে মামলা আছে, অনেকেই জেলে আছেন। পাচার হওয়া টাকা মানুষের হক।’

সাংবাদিকদের উদ্দেশে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এতে (টাকা ফেরত আনতে) বাধা দেবেন না। তাতে টাকা আসবে না। টাকা ফেরত না এলে আপনাদের (সাংবাদিকদের) লাভ কী। প্রশান্ত কুমার হালদারের টাকাও ভারত থেকে আসবে। তাঁকে ফেরতও পাঠাবে। কানাডায় যে টাকায় বাড়ি করেছে, সে টাকাও ফেরত আসবে। এ নিয়ে আমরা কথা বলছি। টাকা কিন্তু আসবে।’

কানাডায় বেগমপাড়া, মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম’, সিঙ্গাপুরে তারকা হোটেল গড়ে তোলা, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের সম্পদ এখন বহুল আলোচিত বিষয়। ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে পাচার হয় ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘৬৪ হাজার কোটি টাকা কেন, ৬৪ টাকা পাচারের হিসাব আছে কি না, আমাকে দেন।’

এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, আয়কর রিটার্নে কেউ ভুলবশত বা অজ্ঞতাবশত তাঁর সম্পদ দেখাননি, তা এখন রিটার্ন হালনাগাদ করার সুযোগ দেওয়া হবে।

সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয় যে বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএফআইইউ, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মতো সংস্থাগুলো টাকা পাচার নিয়ে জানে না, এটা হতে পারে না; জনগণের টাকায় কেন তাঁদের বেতন দেওয়া হচ্ছে? এভাবে দেশে টাকা ফিরিয়ে আনলে যাঁরা নিয়মিত কর দিচ্ছেন, তাঁরা নিরুৎসাহিত হবেন কি না। জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, ‘বিএফআইইউ দেখেছে সুইস ব্যাংকসহ বিভিন্ন দেশে যে অর্থ গেছে, তা বাংলাদেশ থেকে যায়নি। অনেক বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে কাজ করেন। আবার অন্য দেশের নাগরিকত্ব আছে, এমন বাংলাদেশিও আছেন।’

ভর্তুকি, চালের দাম ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, ‘বাজেটটি সংকোচনমূলক করা হয়েছে, যাতে বাড়তি চাহিদা না আসে। আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দাম বেড়েছে ২৩৩ শতাংশ, জনগণের কথা বিবেচনা করে সে তুলনায় আমরা বাড়িয়েছি কম।’

অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন প্রতিদিন ৬৫ কোটি টাকা লোকসান করছে। বিদ্যুৎ, সার ও গ্যাসে বড় অঙ্কের ভর্তুকি যাচ্ছে।

কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গমের দাম বেড়ে গেছে। ফলে চালের ওপর চাপ বেড়েছে। এ জন্য চালের দাম কিছুটা বেড়েছে। সবার প্রবণতা হচ্ছে সরু চালের ভাত খাওয়া। মোটা চালের দাম কিন্তু বাড়েনি।

শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, আগামী সপ্তাহের মধ্যে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি তালিকা প্রকাশ করা হবে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, স্বাস্থ্য খাতে ৪০ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেয়ে তিনি সন্তুষ্ট।

ভালো পরিমাণে প্রবাসী আয় দেশে এলেও বাংলাদেশ থেকেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে প্রবাসী আয় ভারতসহ বিভিন্ন দেশে যায়। আসার তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে থাকলেও যাওয়ার তথ্য নেই কেন—এমন প্রশ্ন করা হলেও কেউ কোনো জবাব দেননি।