উচ্চশিক্ষিতদের উচ্চ বেকারত্ব, সমাধানে প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সম্প্রতিক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে জানা যায়, স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ, অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই বেকার। ওই প্রতিষ্ঠানের মাত্র ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পান এবং মাত্র ৩ শতাংশ স্ব-উদ্যোগে কিছু করছেন। দুই বছর আগেও বিশ্বব্যাংক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর জরিপ করেছিল। তাতেও দেখা গেছে, স্নাতক পাস করা শিক্ষার্থীদের ৪৬ শতাংশ বেকার, যাঁরা তিন বছর ধরে চাকরি খুঁজছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপেও দেখা যায়, দেশে শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই বেকারের হার বেশি, যেখানে ৪৭ শতাংশ শিক্ষিতই বেকার। অন্যদিকে দেশে প্রতিবছর শ্রমশক্তিতে যোগ হচ্ছেন ২০ লাখ মানুষ। কিন্তু সেই অনুপাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। ফলে বড় একটি অংশ বেকার থেকে যাচ্ছেন।

দেশে উচ্চশিক্ষা অর্জনের হার যেমন বাড়ছে, তেমনিভাবে উচ্চশিক্ষিতদের বেকারত্বের হার বৃদ্ধি যেন একটি নৈমিত্তিক খবর হয়ে উঠছে। আবার অন্যদিকে চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও দক্ষ মানবসম্পদের অভাব বোধ করে চলেছে। উচ্চশিক্ষার হার বৃদ্ধি বনাম বেকারত্বের হার বৃদ্ধি—এই ধাঁধার উত্তর খুঁজতে সবার আগে সমস্যার মূল কারণ শনাক্ত করা জরুরি।

একটি দেশের শিক্ষা খাতকে প্রধানত প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা খাতে বিভক্ত করা যেতে পারে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে: ১) একজন মানুষ নিজেকে জানবে, ২) সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো নিজের বুদ্ধি–বিবেচনায় শনাক্ত করতে পারবে, ৩) সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন মেনে তাঁর দৈনন্দিন কর্ম ও জীবন পরিচালনা করবে।

অন্যদিকে উচ্চশিক্ষার প্রধানতম উদ্দেশ্য হচ্ছে: ১) প্রচলিত জ্ঞানের বিকাশ সাধন, ২) সমাজের কিংবা রাষ্ট্রের বিভন্ন সমস্যা এবং এর প্রকৃত কারণ শনাক্ত করা, ৩) সীমিত সম্পদের ব্যবহারের মাধ্যমে ওই সমস্যার সম্ভাব্য সর্বোত্তম সমাধান খুঁজে বের করা, ৪) বিভিন্ন বিশেষায়িত খাতের প্রয়োজন অনুযায়ী professional training–এর মাধ্যমে ওই খাতের জন্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা। এই প্রশিক্ষণ শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক হতে পারে।

‘professional training’ বিষয়ে আমরা বিমান পরিচালনার প্রশিক্ষণের উদাহরণের মাধ্যমে আলোচনা করতে পারি। একজন ট্রেইনি পাইলট তাঁর প্রশিক্ষণকালীন প্রচুর অধ্যবসায় আর একাগ্রতার মাধ্যমে প্রকৃত পাইলট হিসেবে নিজেই একটি বিমান পরিচালনার যোগ্যতা অর্জন করেন। তাঁর মেধা আর কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে অর্জিত দক্ষতা দিয়ে তিনি চাকরিজীবনে বিমান চালনা করে থাকেন। তিনি এ–ও জানেন, তাঁর ব্যর্থতায় প্রাণহানিসহ অনেক বড় ধরনের মানবিক, সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক বিপর্যয় আসতে পারে। যথাযথ ট্রেনিং ও তার প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি সেই ভয়াবহতা থেকে সবাইকে রক্ষা করেন। একজন ট্রেইনি পাইলটের প্রশিক্ষণের গল্পই হতে পারে উচ্চশিক্ষায় professional training-এর দৃষ্টিভঙ্গির প্রকৃত উদাহরণ।
যথাযথ ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ ছাড়া শুধু প্রশিক্ষণের তাত্ত্বিক পরীক্ষায় পাসের ফলাফল দিয়ে পাইলটের পক্ষে সফলভাবে প্রশিক্ষণের বিমান চালনা কখনো সম্ভব নয়। একইভাবে একজন ট্রেইনি পাইলটের ন্যায় উচ্চশিক্ষিতদের বেকারত্বের হার দূরীকরণে এর সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সবার একাডেমিক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি।

অন্যান্য পেশার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব একটি পেশা। এখানে একজন পূর্ণকালীন ছাত্রদের কাজ হচ্ছে ‘অধ্যয়ন করা’। অন্যান্য পেশায় পেশাজীবী যথাসময়ে কার্য সম্পাদন না করলে বেতন বন্ধসহ অনেক শাস্তি হতে পারে, এখানে তা–ই। এর অর্থ হচ্ছে সবাইকে একটি পূর্বনির্ধারিত নিয়ম মেনে কার্যাবলি পরিচালনা করতে হয়। অন্যদিকে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিবছরের একাডেমিক ক্যালেন্ডার পরিবর্তন তথা সময়ানুবর্তিতার পরিবর্তন একটি নৈমিত্তিক ঘটনা। ছাত্রছাত্রীদের দাবিতে কিংবা বিভিন্ন ইস্যুতে ক্লাস/পরীক্ষা পেছানো যেন এ দেশে একটি সাধারণ ঘটনা। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি সপ্তাহে কোনো ক্লাস ব্যতীত শুধু একটি পরীক্ষা নেওয়ার ঘটনাও স্বাভাবিক। আমাদের সবাই একদিকে যেমনিভাবে সেশনজটমুক্ত ক্যাম্পাস চান, আবার অন্যদিকে পরীক্ষা পেছানোর দাবি কিংবা ক্লাসবিহীন এক সপ্তাহে শুধু একটি পরীক্ষা দেওয়ার দাবিও করে থাকেন। পক্ষান্তরে পাইলটের শিক্ষানবিশকালে একটি পরীক্ষা কিংবা ট্রেনিং পিছিয়ে দেওয়ার দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। নির্ধারিত নিয়মের বাইরে নেই কোনো বাড়তি আবদার। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা আর নিয়মানুবর্তিতাই শিক্ষানবিশ পাইলটকে যথাসময়ে একজন দক্ষ পাইলট হিসেবেই তৈরি করে।

তরুণদের জন্য চাকরির বাজার বাড়ছে না। তবে প্রতিবছর হাজারো চাকরিপ্রত্যাশী তরুণের মধ্যে কেউ কেউ দক্ষতা দেখিয়ে চাকরি পেলেও একটি বড় অংশ দরকারি নানা দক্ষতার অভাবে চাকরি পাচ্ছে না
প্রথম আলো ফাইল ছবি

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আরেকটি প্রধানতম কাজ হচ্ছে প্রচলিত জ্ঞানের পাশাপাশি ‘নতুন জ্ঞান’ সৃষ্টি করা। পুরোনো বই কিংবা নোট মুখস্থ করে পরীক্ষায় তা লেখা—একধরনের একাডেমিক ‘চৌর্যবৃত্তি’। এই মুখস্থ বিদ্যার চর্চা তথা চৌর্যবৃত্তি দেশের উন্নয়নের কিংবা নতুনত্বের সৃষ্টির সবচেয়ে বড় অন্তরায়। অন্যজনের সৃষ্ট জ্ঞান মুখস্থ করা অনেকটা একটি পুরোনো গান আবার নতুন করে গাওয়ার সমতুল্য। একটি জনপ্রিয় গান যতই নতুন আঙ্গিকে ভালোভাবে গাওয়া হোক না কেন, তা মূল শিল্পী কিংবা সুরকারদের সৃষ্টির মতো সবার কাছে নতুন করে আর আবেদন পায় না। শ্রোতারাও সেই গান বারবার শুনতে চান না। তেমনিভাবে সিনেমায় নতুন গল্প কিংবা সৃষ্টির নতুনত্ব না থাকলে তা আর দর্শকদের কাছে পুনরায় জনপ্রিয় হয় না। নতুন গল্প কিংবা নতুন গানের সৃষ্টি ছাড়া একজন শিল্পী যেমনিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় না, পুরোনো সমস্যা কিংবা প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করে পরীক্ষায় পাস করা গ্রাজুয়েটরাও কখনো প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন না।

নতুনত্বের সৃষ্টি ছাড়া সমাজের নিত্যনতুন সমস্যার সমাধান অসম্ভব। আর সে জন্যই অনেক নিয়োগকর্তাদের প্রায়ই অভিযোগ করতে শুনা যায়, আমাদের গ্রাজুয়েটরা বাজার চাহিদা অনুযায়ী আউটপুট দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। উচ্চশিক্ষার সঙ্গে বেকারত্বের উচ্চহারের যে সহসম্পর্ক বিভিন্ন সময়ে যেভাবে গবেষণায় উঠে আসছে, তা সম্ভবত উচ্চশিক্ষায় আমাদের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি ও নিয়মিত চর্চার ফলাফল। অর্থাৎ উচ্চশিক্ষিতদের উচ্চ বেকারত্বের হার হচ্ছে একটি ফলাফল, আর কারণ হচ্ছে শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার নন-একাডেমিক দৃষ্টিভঙ্গি আর অপেশাদার আচরণ।

লেখক

উচ্চশিক্ষা ও বেকারত্বের হার বৃদ্ধিজনিত সমস্যা সমাধানে শিক্ষার্থী-শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারকেরা সেই পেশাদার একাডেমিক পরিবেশ নিশ্চিত করবেন। ট্রেইনি পাইলট যেমনিভাবে প্রশিক্ষণকালীন নিজের একাগ্রতা, অধ্যবসায়, নিয়মানুবর্তিতা আর দায়িত্ববোধ দিয়ে যথাসময়ে সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে নিজের বেকারত্বের অবসান ঘটান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও শিক্ষাজীবনে পেশাদার আচরণের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেদের বেকারত্বের অবসান ঘটাতে পারেন। আর এতেই উচ্চশিক্ষিত দক্ষ জনশক্তি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সামগ্রিক বেকারত্বের হার কমবে।

লেখক: ড. মুহাম্মদ আবদুর রহমান ফরহাদ, সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি, মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর। forhad@duet.ac.bd