এলোমেলো বাতাসে লুঙ্গি উড়ছে বিতর্কের আকাশে

লুঙ্গি এ দেশের আপামর পুরুষের প্রিয় এক পোশাক
ছবি: প্রথম আলো

বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঝোড়ো হাওয়া। বইছে অভিযোগের এলোমেলো বাতাস। সেই বাতাসে লুঙ্গি উঠে গেছে বিতর্কের আকাশে। প্রশ্ন উঠছে, ‘লুঙ্গি ডান্স’ আদরণীয় হলে, লুঙ্গি পরে অনলাইনে পরীক্ষা দেওয়া কেন অপরাধ বলে গণ্য হবে?

লুঙ্গি এ দেশের আপামর পুরুষের প্রিয় এক পোশাক। এতে আরাম আছে, স্বাচ্ছন্দ্য আছে। আছে নিজের মতো করে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার সুবিধা। আর সেই লুঙ্গি নিয়ে এখন চলছে ঘোর বিতর্ক। শোনা যাচ্ছে, লুঙ্গি পরে পরীক্ষা দিতে গিয়ে বিপদে পড়েছেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। এরপরেই দেশে–বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে সে খবর। অনেকে একে হাস্যরসের বিষয় বানিয়ে ফেলছে। কিন্তু অতি উপকারী লুঙ্গির সঙ্গে এমনতর আচরণ কি যুক্তিসংগত?

সাম্প্রতিক মূল ঘটনা একটু জেনে নেওয়া যাক। সংবাদমাধ্যমের খবরে প্রকাশ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড প্রসেস অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অনলাইন পরীক্ষা চলাকালে পাঁচ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। প্রশাসন বলছে, পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন ও নিয়ম অনুসরণ না করার কারণে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে বহিষ্কৃত তিনছাত্র বলছেন, লুঙ্গি পরে পরীক্ষা দেওয়ার অভিযোগে তাঁদের বহিষ্কার করা হয়েছে।

লুঙ্গির ব্র্যান্ড যা–ই হোক না কেন, আরাম নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই
ছবি: সংগৃহীত, কোলাজ: একটু থামুন

এটি একটি অভিযোগ। সত্য কি না, তা জানতে কিছুটা সময় লাগবে। তবে লুঙ্গির সঙ্গে তথাকথিত ‘ড্রেস কোড’–এর একটা বিরোধের গন্ধ এখানে পাওয়া যায়। পোশাক হিসেবে লুঙ্গি ‘বেমানান’—এমন বক্তব্যও শোনা যাচ্ছে। অথচ এ দেশে যুগ যুগ ধরে লুঙ্গি আছে প্রধানতম পোশাক হিসেবে। সে হিসেবে লুঙ্গির প্রতি এমনধারা মন্তব্য কি অপমানের শামিল নয়?

অথচ কেউ বলতে পারবেন না যে তাঁরা বাসায় কাউকে কোনো দিন লুঙ্গি পরতে দেখেননি। যদিও লুঙ্গি নিয়ে একধরনের অপপ্রচার বেশ কিছুদিন ধরে চালু হয়েছে। বলা হচ্ছে, লুঙ্গি নাকি ঠিক ভদ্র পোশাক নয়! আচ্ছা, নম্রতা–ভদ্রতা একজন মানুষের আচরণের উপাদান। তা কি শুধু পোশাকে ফুটে ওঠে? আর কথায় তো আছেই, মনের সৌন্দর্যই বড় সৌন্দর্য। অর্থাৎ মনের ভেতরটা সুন্দর না হলে, বাইরে সুন্দর থেকে লাভ কী? আর লুঙ্গিতে তো ঢাকাই থাকে সব, একদম পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত। পারলে দেখান তো, কোথায় ভদ্রতা ভঙ্গ হয়?

আর লুঙ্গির শীতলীকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে তো নতুন করে বলার কিছু নেই। কোনো জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খরচ ছাড়াই যেভাবে লুঙ্গি প্রাকৃতিক শীতলীকরণ প্রক্রিয়া চালু রাখতে পারে, তার তুলনা পাওয়া কি সম্ভব? এ কারণেই বলা যায়, শীত–গ্রীষ্ম–বর্ষা–হেমন্ত, লুঙ্গিতেই আনন্দ! আর ‘বডি’ ও ‘বডি পার্টস’ যদি ঠান্ডা থাকে, হেড তবে থাকবে ‘চিল’ মুডে। আর মাথা ঠিক থাকলে বিরোধ–হানাহানি কমে যাওয়াও কিন্তু বিচিত্র নয়!

লুঙ্গি পরেছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা, সৈয়দ মুজতবা আলী, সাকিব আল হাসান ও হুমায়ূন আহমেদের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরা
ছবি: সংগৃহীত, কোলাজ: একটু থামুন

এ দেশে প্রবাদপ্রতিম রাজনীতিকেরা লুঙ্গি পরতেন। মাওলানা ভাসানীর মতো জনপ্রিয় নেতা আছেন সে তালিকায়। কিংবদন্তি লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী তো লুঙ্গির প্রবল জনপ্রিয়তার কারণ নিয়েও লিখেছিলেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ বর্ষাপ্রধান ও নদীমাতৃক। এ দেশে মানুষ লুঙ্গি বা ধুতিকে তাদের পোশাক হিসেবে বেছে নিয়েছে। এর বাস্তবসম্মত কারণ আছে। তাতে চলাচলের সুবিধা হয়।

দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেও লুঙ্গি বা লুঙ্গির মতো একই ধরনের পোশাকের চল আছে। উল্লেখ করা যায় মিয়ানমার, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভুটান বা নেপালের কথা। এসব দেশের অনেক প্রাতিষ্ঠানিক অনুষ্ঠানেও ওই পোশাক পরেন অনেকে। দক্ষিণ ভারতীয় ছবিতে তো হরহামেশাই নায়কদের লুঙ্গি পরে ‘ডান্স’ করতে দেখা যায়, সেসব আবার জনপ্রিয়ও হয় বেশ। এমনকি শ্বেতাঙ্গরা লুঙ্গি পরে ‘পিক’ দিলে আমরা গর্বে বলি ‘ঠিক ঠিক’! শুধু নিজেদের বেলাতেই যত হট্টগোল।

কার্টুন: তীর্থ

তবে হ্যাঁ, একটা সমস্যা আছে। তা হলো, এলোমেলো বাতাস। এতে অনেক সময় এ দেশের একজন ‘লুঙ্গিম্যান’ কখনো কখনো অনিচ্ছা সত্ত্বেও হয়ে যেতে পারেন মেরিলিন মনরো। হয়তো খানিক মুহূর্তের অসতর্কতা জীবনে ফেলে দিতে পারে কালো দাগ। কিন্তু এই পৃথিবীতে কোন কাজে ঝুঁকি নেই, বলুন তো? আমরা কি আগে থেকে বলতে পারব, কখন বায়ু বইবে শনশন, আর তাতে লুঙ্গি উড়বে ফরফর করে? তা–ও আবহাওয়ার পূর্বাভাস সব সময় বাস্তবায়িত হলে একটা কথা ছিল। অন্তত সে ক্ষেত্রে একধরনের পূর্বসতর্কতা নেওয়া যেতে পারে অবশ্য। তা ছাড়া কথায় তো আছেই, জীবনে ঝুঁকি নেই, তো অর্জনও নেই। কোন ঝুঁকিতে কী অর্জন হয়ে যায়, তা কে বলতে পারে!

সুতরাং লুঙ্গিপ্রেমীদের উদ্দেশে বলি, বিতর্কের বাতাসে ভেসে যাবেন না হুতাশে। বরং লুঙ্গির গিঁট বাঁধুন শক্ত করে। লুঙ্গি নিয়ে টানাটানির এই সময়ে ওটিই যে বেশি দরকার!