পাকিস্তান: নবীর কার্টুন বিরোধী ইসলামপন্থী টিএলপি দলের সরব প্রত্যাবর্তন

টিএলপি নেতা খাদিম হোসেন রিজভির মৃত্যুবার্ষিকীতে টাঙানো পোস্টার
ছবির ক্যাপশান, টিএলপি নেতা খাদিম হোসেন রিজভির মৃত্যুবার্ষিকীতে টাঙানো পোস্টার
  • Author, সুমাইলা জাফরি
  • Role, বিবিসি, লাহোর

নবীর কার্টুন পুন:প্রকাশের ইস্যুতে ফ্রান্স বিরোধী সহিংস বিক্ষোভ সামলাতে কট্টর ইসলামপন্থী তেহরিকে লাব্বাইক পাকিস্তানের (টিএলপি) ওপর থেকে গত মাসে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে ইমরান খানের সরকার।

দলের কারারুদ্ধ নেতা এবং তার শত শত অনুসারীকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। টিএলপিকে পাকিস্তানে মূলধারার রাজনীতিতে অংশগ্রহণেরও অনুমতিও দেয়া হয়েছে।

কিন্তু আশংকা বাড়ছে এসবের প্রভাব শুধু পাকিস্তানে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরঞ্চ দক্ষিণ এশিয়া এবং বাকি বিশ্বের জন্য টিএলপির প্রত্যাবর্তন মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠতে পারে।

টার্গেট -পুলিশ

পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের ওয়াজিরাবাদ শহরের নিরাপত্তার জন্য ৩১শে অক্টোবর পাঠানো হয়েছিল পুলিশ অফিসার ইরফান আহমেদকে।

কারণ ঐ শহরে তখন সপ্তাহ-খানেক ধরে টিএলপির শত শত সমর্থক জড়ো হচ্ছিল। মিছিল করে রাজধানী ইসলামাবাদে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তারা। তাদের দাবি ছিল – ফ্রান্সে নবীর কার্টুন পুনঃ:প্রকাশের জন্য ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করতে হবে। সেই সাথে, তারা তাদের সন্ত্রাসের মামলায় কারারুদ্ধ নেতা সাদ রিজভির মুক্তি চাইছিল।

আরও পড়তে পারেন:

নিহত পুলিশ অফিসার ইরফান আহসানের ছবি হাতে পারিবারের সদস্যরা
ছবির ক্যাপশান, নিহত পুলিশ অফিসার ইরফান আহসানের ছবি হাতে পারিবারের সদস্যরা

ওয়াজিরাবাদে টিএলপির বিক্ষোভকারীরা একদিন পুলিশ অফিসার আহসানকে অপহরণ করে। ভাই উসমান আহসানের ভাষ্যমতে, ওষুধ কিনতে কাছের ফার্মেসিতে গেলে সেখান থেকে তার ভাইকে অপহরণ করা হয়। পরে কাছের একটি হাসপাতালে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। তার সারা শরীরে ছিল নির্যাতনের চিহ্ন ।

“প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছি। ইসলামের রক্ষক বলে যারা নিজেদের দাবি করে, তারাই এভাবে আমার ভাইকে হত্যা করেছে। এটা কোনো ধরণের ইসলাম,“ বিবিসিকে বলেন উসমান।

“শুধু একটা মানুষের মুক্তির জন্য তারা অনেক পরিবার ধ্বংস করেছে। ছোট একটি মেয়েকে অনাথ করেছে।“

তবে টিএলপি বিরুদ্ধে নৃশংসতার অভিযোগ এটাই প্রথম নয়। পাঞ্জাব পুলিশ বলছে এ বছরেই টিএলপির হাতে ১০ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছে। পুলিশের আরো ১৩০০ সদস্য নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

কারা এই টিএলপি ?

খাদিম হোসেন রিজভি নামে কট্টরপন্থী একজন ধর্মীয় নেতা ২০১৫ সালে টিএলপি প্রতিষ্ঠা করেন। ভাষণ দিয়ে মানুষকে খেপিয়ে তোলার অসামান্য ক্ষমতা ছিল তার।

টিএলপি পাকিস্তানের ব্লাসফেমি বা ধর্ম অবমাননা বিরোধী আইনের কট্টর সমর্থক। বিতর্কিত এই আইনে ইসলাম এবং নবীর অবমাননার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

যে বছর টিএলপি প্রতিষ্ঠা হয়, সে বছরই এর প্রতিষ্ঠাতা “নেদারল্যান্ডসকে বিশ্বের মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার“ হুমকি দিয়েছিলেন। ডাচ দক্ষিণ-পন্থী রাজনীতিকে গ্রিট ভিল্ডারস নবীর কার্টুন আঁকার একটি প্রতিযোগিতা আয়োজনের কথা বলার পর টিএলপি নেতা এই হুমকি দেন।

গত বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে নভেম্বরে খাদিম হোসেন রিজভি মারা যান। কোভিড প্যানডেমিক যখন তুঙ্গে। কিন্তু তার মধ্যেই ফ্রান্স বিরোধী বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন, এবং পরে মারা যান।

খাদিম রিজভির মৃত্যুর পর তার ছেলে সাদ রিজভি দলের নেতৃত্ব নেন। ক্ষমতা নিয়েই তিনি দাবি তোলেন পাকিস্তানকে ফ্রান্সের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে।

এপ্রিল মাসে এই দাবিতে টিএলপি ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু করে। ঐ মাসেই দলের কর্মীরা ইসলামাবাদ-মুখী গুরুত্বপূর্ণ সব সড়কে অবরোধ তৈরি করে। সাদ রিজভিকে গ্রেপ্তার করা হয়, এবং তাকে এবং তার কয়েকশ সমর্থককে সন্ত্রাস-বিরোধী আইনে কারাগারে পাঠানো হয়। নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় টিএলপির ওপর।

বিবিসি বাংলার অন্যান্য খবর:

লাহোরে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা টিএলপি সমর্থকদের একটি জমায়েত
ছবির ক্যাপশান, লাহোরে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা টিএলপি সমর্থকদের একটি জমায়েত

নেপথ্যে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান

কিন্তু সাত মাসের মধ্যে টিএলপি এবং সাদ রিজভির ব্যাপারে সরকার তার অবস্থান আমূল বদলে ফেলেছে। দলের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে। রিজভি এবং তার কয়েকশ সমর্থককে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

কেন রাতারাতি অবস্থানের এই বদল তা পরিষ্কার করেনি ইমরান খানের সরকার। তবে বেশ কয়েকটি মিডিয়া রিপোর্টে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে এই সিদ্ধান্তের পেছনে সেনাপ্রধান জেনারেল কামার রশীদ বাজওয়ার হাত ছিল।

সরকার বলেছে, ইসলামের নবীকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে বলে দাবি করে এমন মানুষদের সাথে সংঘাত এড়াতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

তবে অনেক বিশ্লেষক বলছেন এমন একটি গোষ্ঠী যারা নবীর সম্মান ও মর্যাদার রক্ষক হিসাবে নিজেদের তুলে ধরছে তাদের সাথে সংঘর্ষের রাজনৈতিক মূল্যের কথা ভেবেই এই আপোষ করা হয়েছে।

তবে সরকারের মধ্যে এ নিয়ে যে অস্বস্তি রয়েছে তা পরিষ্কার। কিস্তানের তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী বলেন সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে ভারতের চেয়ে পাকিস্তানের জন্য এখন বড় হুমকি ‘অভ্যন্তরীণ জঙ্গিবাদ‘। “যেভাবে টিএলপি ইস্যুতে রাষ্ট্রকে পিছু হটতে হলো, তাতে এটা পরিষ্কার যে জঙ্গিবাদের বোমার সুইচে টিক টিক শব্দ শুরু হয়েছে,'' ইসলামাবাদে সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন মি চৌধুরী।

টিএলপি এবং পাকিস্তানের বিদেশ নীতি

নবীর সম্মান এবং মর্যাদার রক্ষক হিসাবে নিজেদের তুলে ধরছে টিএলপি। বিষয়টি ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের কাছে গভীর আবেগের।

ফলে শুধু পাকিস্তান নয়, বিভিন্ন দেশের নানা মুসলিম গোষ্ঠীর ভেতর টিএলপি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এমনকি ব্রিটেন এবং ইউরোপও তাদের যে অনেক অনুসারী তৈরি হয়েছে – তা এখন ওপেন সিক্রেট।

টিএলপির মিডিয়া সমন্বয়ক সাদ্দাম বুখারি দাবি করেন তাদের প্রতিষ্ঠাতা খাদিম রিজভির জানাজায় অংশ নিতে সারা ইউরোপ থেকে অনেক অনুসারী এসেছিলেন।

পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাকিস্তান ইন্সটিটিউট অব পিস স্টাডিজের আমির রানা বলেন টিএলপি ইস্যুতে সরকারের ভূমিকায় এর মধ্যেই পাকিস্তানের সাথে ইউরোপের কূটনৈতিক সম্পর্কে ছায়া পড়েছে। মি. রানা মনে করেন, মূলধারার রাজনীতিতে টিএলপির আগমনের প্রভাব বাকি বিশ্বেও পড়বে।

“পাকিস্তানের অভ্যন্তরে কী ঘটছে তা নিয়ে হয়তো বাকি বিশ্বের কোনো মাথাব্যথা নেই, কিন্তু ইউরোপে এবং পশ্চিমা বিশ্বে বসবাসরত পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত লোকজন এবং আরো অন্যদের টিএলপি যেভাবে কাছে টানছে, তার দীর্ঘমেয়াদী একটি প্রভাব এড়ানো যাবে না।''

“পশ্চিমা দেশগুলো হয়তো মনে করছে এই যোগাযোগ তাদের জন্য একটি নিরাপত্তা হুমকি তৈরি করবে,“ বলেন মি রানা।

বারেলভি ঘরানার মুসলিমদের কাছে নবীর সম্মান-মর্যাদা অত্যন্ত্য আবেগের একটি বিষয়। টিএলপি সেই আবেগকে এখন পর্যন্ত সাফল্যের সাথে কাজ লাগিয়ে চলেছে।

পাকিস্তানে বারেলভি মুসলিমদের প্রাধান্য সবচেয়ে বেশি। কিন্তু তা সত্ত্বেও, টিএলপি যদি পাকিস্তানের প্রধান একটি রাজনৈতিক শক্তি হতে চায় তাহলে তাদেরকে শুধু নবীর ইস্যু নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না।

তবে, অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন যে টিএলপির মূল আদর্শের যে গ্রহণযোগ্য এবং জনপ্রিয়তা তা পাকিস্তানের অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রভাবিত করছে। এসব দলও কালে কালে দক্ষিণ এবং কট্টরপন্থার দিকে এগুবে।

ইসলামাবাদে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড হাসান আসকারি রিজভি বলেন, পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইতোমধ্যেই ডানপন্থার প্রভাব অনেক বেড়েছে, এবং কিছু এলাকায় টিএলপির জনপ্রিয়তা বাড়লেও জাতীয় নির্বাচনে বিশাল কোন সাফল্য অদূর ভবিষ্যতে তারা পাবেনা।

“টিএলপি হয়তো বড়জোর একটি ক্ষমতাসীন কোয়ালিশনের অংশ হবে। তবে তারা রাজনৈতিকভাবে কতটা শক্তিধর হয়েছে, তা দেখতে আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।''