বিশ্ব চলচ্চিত্রের অলিগলিতে বাংলাদেশের যাঁদের পদচারণ, তাঁদের অনেকের জন্য অনুপ্রেরণার নাম মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। নিজের চলচ্চিত্র নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন উৎসবে তিনি যেমন আমন্ত্রণ পান, তেমনি অন্য দেশের চলচ্চিত্র দেখা ও বিচারকাজের দায়িত্বও আসে তাঁর কাঁধে। সম্প্রতি সে রকম একটি খবর প্রথম আলোর সঙ্গে ভাগাভাগি করলেন ফারুকী। তিনি জানান, সিডনি চলচ্চিত্র উৎসবে বিচারক হওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছেন তিনি। এমন উৎসবের বিচারক হওয়া একটা সুন্দর অভিজ্ঞতা, জানান ফারুকী।
৮ থেকে ১৯ জুন অনুষ্ঠেয় এই উৎসবে বিচারকদের নেতৃত্ব দেবেন অভিনেতা ও নির্মাতা ডেভিড ওয়েনহ্যাম। গত মঙ্গলবার বিচারকদের তালিকা প্রকাশ করেছে সিডনি চলচ্চিত্র উৎসব কর্তৃপক্ষ। এ বছর বিচারকের ভূমিকায় আরও থাকছেন লেখক ও নির্মাতা জেনিফার পিডম (অস্ট্রেলিয়া), বার্লিন গোল্ডেন বিয়ারজয়ী লেখক-নির্মাতা-প্রযোজক সেমিহ কাপ্লানোগলু (তুরস্ক) এবং কাওয়াকিতা মেমোরিয়াল ফিল্ম ইনস্টিটিউটের পরিচালক ইউকা সাকানো (জাপান)।
এশিয়ার চলচ্চিত্র উৎসবগুলোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং অস্ট্রেলিয়ার বড় চলচ্চিত্র উৎসবগুলোর একটি সিডনি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। উৎসবে প্রতিযোগিতা বিভাগে এক ডজন ছবি ছাড়া অন্যান্য বিভাগে ৬৪টি দেশ থেকে থাকছে দুই শতাধিক সিনেমা। তার মধ্যে রয়েছে ফারুকীর নো ল্যান্ডস ম্যান।
এর আগে এশিয়া প্যাসিফিক স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ড, বুসান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ও তালিন ব্ল্যাক নাইটস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বিচারক হয়েছেন ফারুকী। এ ছাড়া আরও কয়েকটি উৎসবে বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এবার যাচ্ছেন সিডনিতে। বাংলাদেশ থেকে বিদেশের উৎসবে বিচারক হওয়ার ব্যাপারটিকে ইতিবাচক মনে করছেন ফারুকী। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন উৎসবের মূল প্রতিযোগিতার বিভাগগুলোয় অনেক দিন ধরেই বিচারক নিয়োগ করা হচ্ছে। আমি নিজেও কয়েকবার হয়েছি। এটা ইতিবাচক বটে। এই অর্থে যে বাইরের দুনিয়া আমাদের দেশ এবং চলচ্চিত্র নির্মাতাদের গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে।’
এ রকম উৎসবে বিচারক হলে দারুণ কিছু অভিজ্ঞতা হয়। বিশ্বের নানা ভাষার নানা ধরনের ছবি দেখা হয়। ফারুকীও বললেন তেমনটাই। ‘সিডনির প্রতিযোগিতা বিভাগ খুবই শক্তিশালী ছবিতে ঠাসা থাকে। যেমন এবারের প্রতিযোগিতায় এ বছর কান উৎসবের আলোচিত বেশ কয়েকটি ছবি আছে। আছে বার্লিনে গোল্ডেন বিয়ারজয়ী ছবি। আছে সানড্যান্স জয় করা ছবিও। ফলে সাম্প্রতিক সময়ের সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো থেকে বেছে সেরা ছবি বের করাটা হবে বড় চ্যালেঞ্জের কাজ,’ বলেন ফারুকী।
প্রতিযোগিতা বিভাগের বিচারকদের একজন হিসেবে উৎসবে যোগ দেবেন ফারুকী, সেই সঙ্গে ১৬ ও ১৯ জুন তাঁর নো ল্যান্ডস ম্যান প্রদর্শিত হবে সেখানে। এ উপলক্ষে মেলবোর্ন থেকে আসবেন ছবির অভিনেত্রী মেগান মিশেল। ১৬ জুন স্থানীয় সময় রাত সোয়া আটটায় জর্জ স্ট্রিটের ৩ নম্বর সিনেমা হলে এবং ১৯ জুন রাত আটটায় প্যালেস সেন্ট্রাল সিনেমা হলে অগ্রিম টিকিট কেটে সিনেমাটি দেখতে পারবেন দর্শকেরা।
দেশের দর্শকেরা ছবিটি কবে দেখতে পাবেন? মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, ‘দেশের দর্শকেরা যে কবে ছবিটি দেখতে পাবেন, সেটাই ভাবছি। আসলে কয়েকটি দেশ মিলিয়ে মুক্তির সহজ উপায় কী হতে পারে, যাতে অর্থনৈতিক দিকটাও ঠিকঠাক থাকে, এসব বিষয় নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমি তো পারলে কালই দেখাই। কারণ, এই ছবি আমার বানানো সবচেয়ে প্রিয় ছবি। আমি ও মেগান সিডনির শোতে থাকব। আমি এক্সাইটেড অস্ট্রেলিয়ান দর্শকদের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য।’
সম্প্রতি কান চলচ্চিত্র উৎসবে ঘুরে এসেছেন ফারুকী। সেখানে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে বলিউড অভিনেতা নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী ও সংগীত পরিচালক এ আর রাহমানের সঙ্গে। সাক্ষাৎ হয়েছে বিশ্ব চলচ্চিত্রের আরও অনেক অভিনয়শিল্পী, পরিচালক ও কলাকুশলীর সঙ্গে। নতুন কী উপলব্ধি হলো? ফারুকী বলেন, ‘আমি তো কান চলচ্চিত্র উৎসবে নির্মাতা হিসেবে যাইনি, গিয়েছি মেয়ের দেখাশোনা করতে। তিশা বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকে কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রে অভিনয় করেছে। সেটার ট্রেলার মুক্তির জন্য তাকে যেতে হয়েছে। সংগত কারণে আমি গিয়েছি ওর সফরসঙ্গী হিসেবে। তবে ব্যক্তিগত সফরে গেলেও সেখানে অনেক কাছের মানুষজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে। নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকীর জন্মদিন ছিল, সে উপলক্ষে ডিনারে গিয়েছি। সেখানেও অনেক বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা হয়েছে। রাহমান ভাই (এ আর রাহমান) ছিলেন তাঁর ভিআর ছবি নিয়ে। তাঁর সঙ্গেও আড্ডা হয়েছে। এশিয়ান চলচ্চিত্রনির্মাতাদের একটা মধ্যাহ্নভোজ ছিল। সেটায় গিয়েছি। এই প্রথম কোনো উৎসবে আমি গেলাম কাজ ছাড়া। কাজ ছাড়া গেলেও ঢেঁকি তো অবধারিতভাবে ধান ভানবেই। ফলে কিছু নতুন কাজের কথাবার্তা তো হলোই।’
দেশের তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতারা বিশ্বের বিভিন্ন উৎসবে প্রশংসা কুড়াচ্ছেন। তাঁদের নিয়ে অনেক আশাবাদের খবর আসছে। তাঁদের সম্ভাবনাটা আসলে কোথায়? কত দূর যেতে পারবেন আমাদের তরুণ নির্মাতারা? এ প্রসঙ্গে ফারুকী বলেন, ‘২০১২ সালে বুসানে যখন ক্লোজিং স্পিচ দিতে উঠি, তখন আমার হাঁটু কাঁপছিল। দুর্বল ইংরেজিতে যে কথা বলার চেষ্টা করেছি, সেটা হলো, বাংলাদেশের দিকে চোখ রাখুন। আমাদের পাইপলাইনে অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ নির্মাতা আছেন। তাঁরা বিচিত্র সব গল্প নিয়ে হাজির হবেন শিগগিরই। এ কথা তখনো বিশ্বাস করেছি, এখনো করি। আমাদের কেবল সামনে যাওয়ার পালা, আমাদের কেবল নতুন নতুন দিগন্ত খোলার পালা।’
সবকিছু ছাপিয়ে চার মাসের মেয়েকে নিয়ে কানে বেড়াতে কেমন লেগেছে? চার মাসের ইলহাম বাবার সঙ্গে কানে গেল, অস্কার তার জন্য ডালভাত হয়ে যাবে নিশ্চয়ই? এমন প্রশ্নে হাসতে হাসতে ফারুকী বলেন, ‘আমরা জানি না ইলহাম বড় হয়ে কী করবে বা কোথায় নিজেকে দেখতে চাইবে। মা-বাবা হিসেবে আমরা শুধু নিশ্চিত করতে চাইব যে সে ঠিকভাবে বড় হচ্ছে। তারপর ওর রাস্তা ও-ই বেছে নেবে। তবে হ্যাঁ, একদিক থেকে দেখলে তো ব্যাপারটা মজারই লাগে। আমার বাবা জীবনে কোনো দিন বিদেশে যাননি, পরিণত বয়সে হজ করতে যাওয়া ছাড়া। আমার প্রথম বিদেশ সফর ছিল কলকাতা। আর আমার মেয়ের প্রথম বিদেশ সফর ফ্রান্সে। ওর সন্তানেরা হয়তো জন্মই নেবে বিদেশে। এভাবেই দিগন্ত বদলে বদলে যায়।’