অন্যের পথচলা সহজ করেন, তবু নিজের সংসারে টানাটানি
রাত নয়টা পেরিয়ে গেছে। জায়গাটি ব্যস্ততম হলেও বৃষ্টির জন্য অন্য সময়ের মতো নেই ভিড়বাট্টা। হাত-পা গুটিয়ে অপেক্ষায় বসে আছেন মিলন রবিদাস (৩১)। যদি কেউ জুতা সেলাই করতে আসেন। সারা দিন বৃষ্টি থাকায় দেরিতে (বিকেল পাঁচটার দিকে) কাজে এসেছেন। রোজগারেও তাই অন্যদিনের চেয়ে বেশি টানাটানি।
গতকাল সোমবার রাতে মৌলভীবাজার শহরের চৌমোহনা চত্বরে এ দৃশ্যের দেখা মেলে।
মিলন রবিদাসের বাড়ি মৌলভীবাজার শহরতলির মাইজপাড়ায়। প্রতিদিন সকাল ১০ থেকে বেলা ১১টার দিকে চৌমোহনা চত্বরে এসে আসন পাতেন। ফুটপাতের একচিলতে জায়গায় তাঁর মতো আছেন সাতজন। সবারই একই কাজ—যা চলে রাত ১০টা পর্যন্ত।
১৭ বছর আগে বাবার আসনটিতে এসে বসেছিলেন মিলন। ভাঙাচোরা জীবনটাকে টেনেটুনে এখন তিনি পরিণত যুবক। চোখের সামনে শহরটার কত অদলবদল দেখেছেন। কিন্তু মিলন সেই যে সুই–সুতা নিয়ে ছেঁড়া, টুটাফাটা জুতা সেলাইয়ের কাজে নেমেছিলেন, সেটাই তাঁর জীবিকার একমাত্র অবলম্বন।
সময় অনেক পাল্টেছে। সবকিছুতে ‘ওয়ান টাইম’ ভর করেছে। ছেঁড়া জুতা সেলাই বা মেরামতের পুরোনো দিনকাল এখন আর নেই। মিলন রবিদাসদের পারিবারিক এই আদি পেশাটিতে হয়তো কোনো এককালে জৌলুশ ছিল। এখন চলছে টিকে থাকার সংগ্রাম।
গতকাল রাতে মিলনের সঙ্গে কথা বলার মধ্যেই পরপর দুজন খদ্দের আসেন। হাত সচল হয়ে ওঠে। টুকটাক কথাও চলে। মিলন জানান, তিনি তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন। একদিন বাবার সঙ্গে এসে কাজে যোগ দেন। বাবাকে ছোটবেলা থেকে এ কাজ করতে দেখেছেন। ফলে তাঁর কাছে বিষয়টি চেনা ও সহজই ছিল। এখানে কাজ করতে করতেই বিয়ে করেছেন। এক ছেলে, এক মেয়ের বাবা হয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে থাকছেন মা–বাবাও।
একদিকে দ্রব্যমূল্য বাড়ছেই, অন্যদিকে জুতা সেলাইয়ের পেশায় নেই আগের মতো আয়। ফলে সংসারে টানাটানি নিত্যসঙ্গী হয়ে গেছে মিলন রবিদাসের। তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও দুই-আড়াইশ টাকা রুজি অইতো। মোটামুটি ভালাই চলা যাইতো। চাউলের দাম কম আছিল। এহন এক কেজি চাউলের দাম কত! চাউল নিলে তো আর কুনতা (কিচ্ছু) নিতাম (নিতে) পারি না।’
সারা দিনে ৩০০ টাকার মতো আয় হয় মিলনের। এর বাইরে ভাববার সুযোগ নেই। কোনো বদলও নেই জীবনের। কখনো যে পেশা বদলানোর কথা ভাবেননি, এমন না। কিন্তু বদলটা করবেন কীভাবে! হাতে সঞ্চয় বলে কিছু নেই। কিছু করতে গেলে তো পুঁজি লাগে।
কথা বলতে বলতে আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েন মিলন। বলেন, ‘কিতা করমু! সরকার জিনিসপত্রের দাম বাড়াইছে। আর কিচ্ছু তো করার নাই। যত রুজি, খরচ এর বেশি। যা রুজি করি, তাতে চলতে কষ্ট অই যায়। এর মাঝে বৃষ্টি অইলে মানুষ নাই। কামও নাই।’
একদিকে কোনো বিকল্প নেই, অন্যদিকে দীর্ঘদিন একই কাজ করায় পেশার প্রতি মায়া পড়ে গেছে মিলনের। নিজের পথচলা যত কঠিনই হোক, ছেঁড়া জুতা সেলাই করে দিয়ে মানুষজনের পথচলাকে সহজ করাতেই তাঁর ভালো লাগা। কাজ শেষে যে যা দেন, পুষিয়ে গেলে চুপচাপ নিয়ে নেন।
মিলন রবিদাস বলেন, ‘গরিব মানুষ, সপ্তাহে এক দিনও মাছ কিনার (ক্রয়) কথা ভাবতাম পারি না।’ একগাল হেসে বলেন, ‘মাঝেমাঝে জাল নিয়া নদীতে (মনু নদে) যাইগি (চলে যাই)। কিছু পাইলে আরও একবেলা মাছ খাওয়া অয় (হয়)!’
মিলন রবিদাসের মতো আরও কয়েকজন এভাবে চৌমোহনা চত্বরে বসে থাকেন। এই রঙিন, ঝকঝকে আলোর ভেতরে অন্যের ছেঁড়া জুতা সেলাই করে যাঁদের জীবনটা চলে; তাঁদের টুটাফাটা জীবনটাকে সেলাই করার কোনো সুযোগ যেন আর নেই। ঝড়-বৃষ্টি, শীতের মধ্যে একভাবে চলছে তো চলছেই।